নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : পেট্রোবাংলার গাড়িচালক সাইফুল বারীর কন্যা শামীমা নূর পাপিয়া। কীভাবে পাপিয়া এত বিত্তবৈভবের মালিক হলেন? এখন সেই প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা তিন মাস ধরে পাপিয়ার কর্মকাণ্ড ও তার সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে। সবকিছু নিশ্চিত হয়েই গ্রেফতার করা হয় পাপিয়াকে। হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেসিডেন্ট সুটটি তিনি বানিয়েছিলেন ‘রংমহল’। সেখানে যাতায়াত ছিল অনেক প্রভাবশালীরও। অনেক গুমোর ‘ফাঁস’ হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় তাকে ছাড়াতে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিরা ব্যাপক তদবিরও করেছেন। কিন্তু র্যাবের কঠোর অবস্থানের কারণে তাকে ছাড়ানো যায়নি।
গতকাল সোমবার নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরীকে তিন মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৫ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত। মামলা তিনটি করেছে র্যাব। রিমান্ডের পর তাদের নরসিংদী নেওয়া হয়। পাপিয়াসহ চার জনকে শনিবার ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। সে সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, ২ লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ টাকার জাল নোট এবং সাতটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের বাসায় অভিযানের সময় পাওয়া গেছে নগদ ৫৮ লাখ টাকা। ইন্দিরা রোডে ‘রওশনস ডমিনো রিলিভো’ নামে বিলাসবহুল ভবনে তাদের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে নরসিংদীতেও। সেখানে ২ কোটি টাকা দামের দুটি প্লটও রয়েছে। কালো ও সাদা রঙের দুটি হায়েস মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়াহ ও একটি ভিজেলসহ পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে তার। এফডিসির সামনে কার এক্সচেঞ্জ নামে একটি গাড়ির শোরুমে পাপিয়ার ১ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। নরসিংদী শহরে কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সল্যুশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তার ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের গচ্ছিত রয়েছে কয়েক কোটি টাকা। অথচ তার কোনো ব্যবসা নেই। তিনি শুধুই একজন রাজনীতিক, পদ নরসিংদী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক।
নরসিংদীর ব্রাহ্মণদির গ্রাম্য বাউল শিল্পী মতিউর রহমানের ছেলে সুমন চৌধুরী ছিলেন সাবেক মেয়র লোকমানের বডিগার্ড। প্রেমের বিয়ে পাপিয়া ও সুমনের। অসচ্ছল পরিবারের ছেলে সুমন ও ড্রাইভার কন্যা পাপিয়া শুরুতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন। দুজনই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। দেখতে সুন্দর, অল্প বয়সী পাপিয়া অল্প দিনেই রাজনীতিতে একটা অবস্থান তৈরি করে ফেলেন। এরপর তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ওয়েস্টিনের ‘রংমহল’ই তাকে অর্থ-বিত্ত-সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। প্রেসিডেন্সিয়াল সুট ভাড়া নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যে আয় করতেন, তা দিয়ে হোটেলে বিল দিতেন কোটির টাকার ওপরে।
ঐ সুটে যারা আসতেন তাদের মদ-বিয়ারসহ অন্যান্য আপ্যায়নের পেছনে প্রতিদিন ব্যয় করতেন আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। প্রভাবশালীদের খুশি করেই বাগিয়ে নিতেন বিভিন্ন কাজ। সেগুলো আবার বিক্রি করে বিপুল টাকা উপার্জন করতেন। অনেক ক্ষমতাধরেরও সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সেখানে যেতেন।
বিমানবন্দর থানায় তাদের বিরুদ্ধে জাল মুদ্রা পাওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এছাড়া অস্ত্র ও মদ উদ্ধারের ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আরো দুটি মামলা করা হয় পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে। সোমবার ওই চার জনকে ঢাকার হাকিম আদালতে হাজির করে তিন মামলাতেই ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। তিনটি মামলাতেই আদালত পাঁচ দিন করে ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
র্যাবের অনুসন্ধানে মিলেছে পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নামে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা ও একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স দেওয়ার নাম করে ২৯ লাখ টাকা নিয়েছেন তারা। এছাড়া নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক, অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড রয়েছে তাদের, যার মাধ্যমে তারা কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন। ২০০০ সালের দিকে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক ছিলেন সুমন। তখন থেকেই চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ব্ল্যাকমেইল ছিল সুমনের প্রধান পেশা। চতুর সুমন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পর তিনি আলোচনায় আসেন। এরপর আরো একজনকে হত্যার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে পাপিয়াকে বিয়ে করেন। এরপর স্ত্রীকে রাজনীতিতে কাজে লাগান।
সুমন-পাপিয়া দম্পতি যখন নরসিংদী যেতেন সামনে অন্তত ৫০ জনের মোটরসাইকেল নিয়ে আর পেছনে আরো অন্তত ১০টি গাড়ি থাকত। শনিবার ভারতে যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে তাদের বোর্ডিং শেষ হওয়ার পর ইমিগ্রেশনের আগেই র্যাবের একজন কর্মকর্তা পাপিয়া ও তার স্বামীকে থামান। তখন তারা নিজেদের ক্ষমতার কথা জানিয়ে বারবার বলেন, র্যাব ভুল করছে। এ সময় তারা উচ্চ পর্যায়ের কাউকে ফোনও করার চেষ্টা করেন। কিন্তু র্যাব তাদের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়নি। এরপর তাদের সোজা নিয়ে আসা হয় র্যাব-১ কার্যালয়ে। সেখানে বিশাল স্ক্রিনে পাপিয়ার সকল কর্মকাণ্ড দেখায় র্যাব। বড়ো পর্দায় নিজের কর্মকাণ্ডের ছবি দেখে মাথা নিচু করে রাখেন পাপিয়া ও সুমন। এরপর সবকিছু অকপটে বলতে থাকেন পাপিয়া। সার্বক্ষণিক পাপিয়ার সঙ্গে থাকা ৬ তরুণী র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্যই জানিয়েছে। তারা র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ‘ওই রংমহলে এত উচ্চ পর্যায়ের মানুষ আসতেন যে, পাপিয়াকে বেশি দিন আটকে রাখা সম্ভব হবে না। তিনি যেভাবেই হোক বেরিয়ে আসবেন। তথ্য দেওয়ায় তাদের হাল বেহাল করে দেবেন।’