ফাঁদে ফেলে প্রতারণার ভিডিও করায় খুন

গাজীপুরে সাংবাদিক হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক : গাজীপুর মহানগরীর ব্যস্ততম এলাকা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা। প্রতিদিন নানা প্রয়োজনে লাখো মানুষ চলাচল করেন। এ কারণে সেখানে বেড়েছে ছিনতাইসহ নানা অপরাধ। গড়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। পুলিশ বলছে, চক্রগুলো নারী সদস্যদের দিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে (হানিট্র্যাপ) মানুষের কাছ থেকে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নেয়।

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মিজান ওরফে কেটু মিজান (৩৪) ও তাঁর স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপীর নেতৃত্বে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘হানিট্র্যাপ’ নামের একটি চক্র। সেই চক্রের ফাঁদে পড়েন এক ব্যক্তি। আর সেই ফাঁদে পড়ার সময় চক্রটির অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়ার ভিডিও ধারণ করায় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গতকাল শনিবার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি) কমিশনার নাজমুল করিম খান।

সাংবাদিক আসাদুজ্জামান হত্যাকাণ্ডের কারণ এবং এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে তথ্য জানাতে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। পুলিশ কমিশনার বলেন, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাদশা নামের এক ব্যক্তি ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার টাকা তুলে ফিরছিলেন। পথে অভিযুক্ত গোলাপী তাঁকে ফাঁদে ফেলে প্রতারণার (হানিট্র্যাপ) চেষ্টা করেন। বিষয়টি টের পেয়ে বাদশা গোলাপীর সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরে আসতে চান। এ সময় আগে থেকে ওত পেতে থাকা অন্য আসামিরা বাদশাকে কোপাতে শুরু করেন। প্রাণ বাঁচাতে বাদশা দৌড় দিলে ঘটনাটি পেশাগত দায়িত্বে ভিডিও করেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন।

কমিশনারের ভাষ্য, ভিডিওটি দেখে ফেলেন আসামিরা। তাঁরা তুহিনকে ভিডিওটি মুছে ফেলতে বলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। একপর্যায়ে তাঁরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক দল প্রায় ৩০ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ বিষয়ে গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান বলেন, গত শুক্রবার দিবাগত রাতে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের ধরা হয়। এর মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব, অন্য ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে জিএমপি। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে আমরা আটজনকে চিহ্নিত করেছি। অন্য একজন রয়েছেন, তাঁকেও দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে পারব।’

সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান বলেন, ‘পুলিশের একার পক্ষে অপরাধ দমন সম্ভব নয়, জনগণের সম্পৃক্ততা দরকার। সুরক্ষার দায়িত্ব আমার ওপর ছিল। আমরা সাধারণত দুটি কাজ করি—প্রিভেনশন (অপরাধ প্রতিরোধ) ও ডিটেকশন (অপরাধ উদ্‌ঘাটন)। প্রিভেনশনটি আমরা করতে পারিনি। প্রিভেনশন সব সময় করা যায় না। বিশ্বের কোনো দেশেই ক্রাইম শূন্যে নামানো সম্ভব হয়নি। তাই শত চেষ্টার পরও অপরাধ হয়ে যেতে পারে। যে ঘটনাটি ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।’

পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘গাজীপুরে ৫ আগস্টের পর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলে ক্রাইম বেড়ে যায়। এটা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। আগের রেজিম এই জেলায় শক্তিশালী। সেই দলটি গাজীপুরকে অস্থিতিশীল করছে। সেটিও নজরদারি করা হচ্ছে। এই নজরদারি করতে গিয়ে অন্যান্য অপরাধে মনোযোগ নষ্ট করছে। তবে মানুষের স্বস্তি ফেরাতে কাজ করছে জিএমপি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে পেলেই আসাদুজ্জামান হত্যা মামলার চার্জশিট ১৫ দিনের মধ্যে দেওয়া হবে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার দ্রুত নিশ্চিত করা হবে।’

বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্যে সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে (৩৮) ছিনতাইকারীরা কুপিয়ে হত্যা করে। তিনি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। আসাদুজ্জামান ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের হাসান জামালের ছেলে। তাঁকে হত্যার অভিযোগে তাঁর বড় ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে শুক্রবার নগরের বাসন থানায় মামলা করেন।

এখন পর্যন্ত আসাদুজ্জামান হত্যা মামলায় সাতজন গ্রেপ্তার হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে মিজান ওরফে কেটু মিজান, তাঁর স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপী, খুলনার সোনাডাঙ্গা থানার ময়লাপোতা গ্রামের মো. হানিফের ছেলে আল-আমীন, পাবনার ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. স্বাধীন, কুমিল্লার হোমনা থানার অনন্তপুর গ্রামের হানিফ ভূঁইয়ার ছেলে মো. শাহজালাল, পাবনার চাটমোহর থানার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের কিয়ামদ্দিন হাসানের ছেলে ফয়সাল হাসান ও শেরপুরের নকলা উপজেলার চিতলিয়া গ্রামের আবদুস সালামের ছেলে সুমন ওরফে সাব্বির। তাঁদের মধ্যে স্বাধীনকে র‌্যাব সদস্যরা গ্রেপ্তার করেছেন।

সাংবাদিক আসাদুজ্জামান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাত আসামিকে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বিকেলে গাজীপুরের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলমগীর আল মামুনের আদালত এই আদেশ দেন।

গতকাল সকালে গাজীপুর মহানগরীর র‌্যাব-১-এর পোড়াবাড়ী ক্যাম্পে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওই কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার কে এম এ মামুন খান চিশতী দাবি করেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার হওয়া মো. স্বাধীন সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। আসাদুজ্জামানকে টার্গেট করেই হত্যা করা হয়েছে বলে স্বাধীন র‌্যাবকে জানিয়েছেন।

গত শুক্রবার ও গতকাল চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চান্দনা চৌরাস্তা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা। এখনে ব্যাংক, ব্যবসা এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়া–আসাসহ নানা কারণে এখানে আসতে হয়। একসময় যেখানে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ সদস্যদের দেখা যেত, এখন পুলিশ নেই বললেই চলে। এ কারণে এখানে প্রতিদিন ছোট-বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু অপরাধীরা ধরা পড়ছে না।

চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার শাপলা ম্যানশন এলাকায় কথা হয় আবদুল হাকিম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাত-আট দিন আগে আমার এক বন্ধু ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য চৌরাস্তা এলাকায় আসেন। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় এক নারী ইচ্ছা করে তাঁকে ধাক্কা দেন। পরে ওই নারী চিৎকার–চেঁচামেচি করতে থাকেন। তখন পাশ থেকে পাঁচ-ছয়জন লোক এসে কী হয়েছে জানতে চান। তখন আমার বন্ধু তাঁদের ঘটনাটি বললেও ওই ব্যক্তিরা আমার বন্ধুকেই দায়ী করেন। পরে তাঁরা আমার বন্ধুর সঙ্গে থাকা ৮ হাজার ২০০ টাকা ও মুঠোফোনটি নিয়ে চলে যান।’

চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ফুটপাতে ব্যবসা করেন হাসান আলী। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে বসে দেখি, শুনি কিন্তু কিছু বলতে পারি না। কয়েকটি গ্রুপ আছে যাদের সঙ্গে নারীরা থাকে। তারা যৌনকর্মী ভাড়া করে নিয়ে তারপর নানা ধরনের ফাঁদে ফেলে মানুষের টাকাপয়সা লুট করে নিয়ে যায়।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে শ্রমিকদের বেকারত্ব, অপরিকল্পিত ঘনবসতিপূর্ণ নগরায়ণ, পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতা এবং অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যতম।

সাংবাদিক হত্যার ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি

গাজীপুর মহানগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। পাশাপাশি ঘটনাস্থলের সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।

গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানিয়েছে এমএসএফ। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামালের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বক্তব্যে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ব্যক্ত করা হয়ে থাকে। সরকার দেশের সব নাগরিকের মতো সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত করা, ভয় দেখানো এবং চিরতরে তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার একটি ভয়ংকর অপতৎপরতার উদাহরণ হচ্ছে এই ঘটনা। সাংবাদিকদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রতিটি সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হওয়া দরকার বলে মনে করে এমএসএফ।

Share