নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ফিলিস্তিনে হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, বুধবার থেকেই ফিলিস্তিনে হামলা বন্ধ দেখতে চান বলে নেতানিয়াহুকে জানিয়েছেন বাইডেন। তবে এ আহ্বানের মধ্যেই হামলা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
অবশ্য বাইডেনের আহ্বান জানানোর আগেও নেতানিয়াহু বলেছিলেন, আমরা স্টপওয়াচ নিয়ে বসে নেই। খবর আলজাজিরা, বিবিসি, এএফপি ও গার্ডিয়ানের।
বাইডেন এমন সময় নেতানিয়াহুকে হামলা বন্ধের আহ্বান জানালেন যখন টানা ১০ দিন ইসরায়েলের বিভীষিকায় বাস্তুহারা হয়েছে কমপক্ষে ৭২ হাজার ফিলিস্তিনি। চরম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে তারা। খাদ্য, পানি, জ্বালানির তীব্র সংকটে অনেকে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। অথচ সীমান্ত আটকে রেখে তাদের কাছে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তাও পৌঁছাতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি সেনারা। এ অবস্থাকে যুদ্ধাপরাধের শামিল বলে বর্ণনা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও বুধবার ভোরে মাত্র ২৫ মিনিটে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় ১২২ বার বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে এক সাংবাদিকসহ চারজন নিহত হয়েছেন। এর আগে ওই দিন রাত ১০টা থেকে হামাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ টানেল লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো হয়। এ নিয়ে টানা ১০ দিনের হামলা ও গোলার আঘাতে রক্তাক্ত ফিলিস্তিনে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, বসতবাড়ি, করোনা চিকিৎসাকেন্দ্রসহ সাড়ে চারশর বেশি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে।
চাপ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তার স্বার্থে ফিলিস্তিনে হামলা অব্যাহত থাকবে। তবে পরিস্থিতি বুঝে হামলা বন্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। বুধবার তেল আবিবে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের তার দেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সময় এ ইঙ্গিত দেন নেতানিয়াহু। তবে এ সময় তিনি গাজা উপত্যকা দখলের বিষয়টি উড়িয়ে দেননি। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের সব হয় দখল করে নিতে হবে- এই সম্ভাবনা সব সময় থাকে। অথবা তাদের বাধা দিতে হবে। এ মুহূর্তে আমরা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের বাধা সৃষ্টি করছি। কিন্তু আমি কোনো কিছুরই সম্ভাবনা বাদ দিচ্ছি না।
এদিকে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গত মঙ্গলবার চতুর্থ দফায় বৈঠক করেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে ইসরায়েলকে নিন্দা করে বিবৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করা যাবে না বলে এবারও যুক্তি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় মিসরের নেতৃত্বে অস্ত্রবিরতি বা যুদ্ধবিরতির যে প্রচেষ্টা চলছে, তাতে যোগ দিয়েছে ফ্রান্স। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেছে, তারা ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আনতে চেষ্টা করবে।
বুধবার ইসরায়েলি হামলায় গাজাসহ ফিলিস্তিনে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে জেনেভায় জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ‘অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স (ওসিএইচএ)’।
সংস্থাটির বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, ফিলিস্তিনে সাড়ে চার শতাধিক স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৩২টি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ৩১৬টি আংশিক ধ্বংস হয়েছে। এরমধ্যে ছয়টি হাসপাতাল এবং ৯টি স্বাস্থ্য ও করোনা কেন্দ্র রয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৭২ হাজার মানুষ। এরমধ্যে গাজায় জাতিসংঘ পরিচালিত ৫৮টি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি।
ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, টানা ১০ দিনের হামলায় ফিলিস্তিনের ৬৫ শিশুসহ ২৪৩ ব্যক্তি নিহত ও এক হাজার ৩০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গাজায় নিহতের সংখ্যা ২১৯ এবং পশ্চিমতীরে ২৪। অন্যদিকে ইসরায়েলে ১২ জন নিহত ও ৩৩৩ জন আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি হামলায় পানি সরবরাহ কেন্দ্র ধ্বংস হওয়ায় পানীয় জলের চরম সংকটে পড়েছে গাজার প্রায় আড়াই লাখ বাসিন্দা। জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক ত্রাণ সংস্থা থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষকে খাবার ও অন্যান্য সাহায্য দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানায় ওসিএইচএ।
তাৎক্ষণিক সহায়তার জন্য ৩৭ মিলিয়ন ডলার আবেদন জাতিসংঘের : ইসরায়েলি বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের তাৎক্ষণিক সহায়তার জন্য ৩৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা আবেদন করেছেন ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ত্রাণ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ। মঙ্গলবার গাজায় এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তহবিলে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে ওই অর্থ দান করার জন্য আহ্বান করেন সংস্থার পরিচালক ম্যাথিয়াস শামলে। এ সময় তিনি বলেন, ‘অবরুদ্ধ গাজায় প্রবেশের জন্য কিছু জ্বালানি তেলের ট্রাককে অনুমতি দেওয়া হলেও খাদ্য সহায়তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা নিরাপদ মানবিক করিডোর তৈরির চেষ্টা করছি।’
গাজার মানবিক সংকট ‘উদ্বেগজনক’ উল্লেখ করে তাৎক্ষণিকভাবে বেইট হ্যানুন ও কারেম আবু সালেম করিডোর বা সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস গাজার মানবিক সংকট মোকাবিলায় পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘আমরা গাজায় ব্যাপক অবকাঠামো ও বসতবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি এবং মানবিক ভোগান্তি লক্ষ্য করছি।’
এর আগে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের প্রধান মার্ক লোকর্ক এক বিবৃতিতে বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি রোধে জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী, জ্বালানি ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের জন্য গাজার সীমান্তগুলো উন্মুক্ত রাখা জরুরি।’
৯২ ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েল : তেল আবিবের আগ্রাসনের প্রতিবাদে পশ্চিমতীর ও ইসরায়েলে বিক্ষোভের পর মঙ্গলবার রাতভর অভিযান চালায় ইসরায়েল। এতে ইসরায়েলে ৫৮ ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। বুধবার আরব মাইনরিটি রাইটস ইন ইসরায়েলের লিগ্যাল সেন্টার এ তথ্য নিশ্চিত করে। এ ছাড়া পশ্চিমতীর থেকে ২১ ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করে ইসরায়েলি বাহিনী। হেবরন থেকে তিন, নাবলুস থেকে তিন, জেনিন থেকে তিন, বেথলেহাম থেকে চার ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।
এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ইহুদি বিদ্বেষের অভিযোগ, প্রত্যাখ্যান তুরস্কের : ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের টানা বিমান হামলা নিয়ে শুরু থেকেই সোচ্চার রয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান। ওই আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমর্থনের পর তার কড়া সমালোচনা করেন এরদোয়ান। বলেন, ‘বাইডেনের হাতে ফিলিস্তিনিদের রক্ত।’ এরপর তুর্কি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ করে ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এরদোয়ানের মুখপাত্র ওমর সেলিক বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আনা ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ অযৌক্তিক ও অসত্য।’
গাজায় বিমান হামলায় সাংবাদিকসহ নিহত ৪ : গাজা উপত্যকায় বুধবারের বিমান হামলায় আল-আকসা ভয়েস রেডিওর সাংবাদিক ইউসেফ আবু হুসেইনসহ চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও তিনজন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ওয়াফা নিউজ এজেন্সি বলছে, বুধবার সেন্ট্রাল গাজা নগরীতে রকেট হামলা চালালে স্বামী, স্ত্রী ও তাদের এক সন্তান নিহত হন। এ ছাড়া রাদওয়ান এলাকার ওই রেডিও স্টেশনের ভবনে হামলায় ইউসেফ মারা যান।
হামলায় ৫০ স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত : আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেন ও ইউনিসেফ বলছে, ইসরায়েলের বিমান হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৫০টি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে গাজায় এখন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে কমপক্ষে ৪১ হাজার ৮৯৭ শিক্ষার্থী। গাজার প্রতি ১৫টি স্কুলের একটি বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় আহত হয়েছে কমপক্ষে ৪৫০ শিশু শিক্ষার্থী।
সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর (ফিলিস্তিন অঞ্চলবিষয়ক) জেসন লি বলেন, ‘এ অঞ্চলের কোনো শিশুই এখন আর সহিংসতার প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। সংঘাতের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে কোমলমতি শিশুদের ওপর।’
আগ্রাসনের প্রতিবাদে দেশে দেশে বিক্ষোভ : ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হয়েছে প্রতিবাদী মিছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে চিলিতে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছে। দেশটির সান্তিয়াগো শহরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে প্রায় তিন লাখ মানুষ অংশ নেন।
এএফপি বলছে, সান্তিয়াগোর পূর্বে অংশে দেপোর্তিভো প্যালেস্টিতো ফুটবল ক্লাবের সদর দপ্তরে হাজারের বেশি মানুষ জড়ো হয়ে প্রতিবাদ জানান। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেসসহ বিশ্বের বড় বড় নগরীতে বিক্ষোভ হয়েছে। বোস্টনের মিছিলে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়ে আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানান।