গাজী আবু বকর : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে জন্ম নিয়েছে ‘বাংলা বসন্ত’। এই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের আনন্দে ‘বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করলে কলঙ্কিত হবে জাতি’।
দেশ কাঁপানো ২৩ দিনের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে, জনতার হয়েছে বিজয়, হাসিনা নিয়েছে বিদায়। পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। শেখ হাসিনা গত ৫ আগষ্ট সোমবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এরপর বঙ্গভবন থেকে বিদায় নিয়ে সামরিক বাহিনীর বিশেষ বিমানে দেশ ছাড়েন। সে সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর বোন শেখ রেহানা। শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তাঁর টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের বিপুল রায় নিয়ে তিনি ক্ষমতায় বসেছিলেন। এরপর নিজের শাসনামলে আর কোনো গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন তিনি হতে দেননি। ২০০৮ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তারপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর যে তিনটি নির্বাচনের পর তিনি গদি ধরে রাখেন, সেগুলো খুবই বিতর্কিত ছিল। এই নির্বাচনগুলো মোটেও অংশগ্রহণমূলক ছিল না। তিনি ক্ষমতাকে এতটাই সুসংহত করেছিলেন যে তাঁকে প্রায় অজেয় বলে মনে হয়েছিল। তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছিলো সীমাহীন অহংবোধ, একনায়কতন্ত্রের স্বৈরাচারি মনোভাব। হরণ করেছিলেন মত প্রকাশের বাক স্বাধনিতা।
শেখ হাসিনার মেয়াদকালে দেশটির মাথাপিছু আয় এক দশকে তিন গুণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের অনুমান, গত ২০ বছরে দেশটির আড়াই কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাসিনার সরকার দেশীয় তহবিল, ঋণ এবং উন্নয়ন সহায়তার সমন্বয়ে ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার ব্যয়ে পদ্মা সেতুর মতো অনেক উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তবে এই অর্থনৈতিক অর্জনের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। প্রধান বিরোধী দলগুলোর ভোট বর্জন, নামমাত্র ভোটার উপস্থিতি ও সহিংসতা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ভোটাধিকার ও বাক্স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থ পাচার, দেশকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের কবলে ফেলা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, ঋণের নামে ব্যাংক লুটের সুযোগ দেওয়া, আয়বৈষম্য চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াসহ বিস্তৃত অভিযোগ রয়েছে। এসবের বিপরীতে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে। কিন্তু শেষ সময়ে অর্থনীতিকেও সরকার সংকটে ফেলে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) কমে গেছে, খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে, দ্রব্যমূল্য সীমিত আয়ের মানুষের নাগাল ছাড়া হয়ে গেছে। দেশের মানুষের এসব সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের মন্ত্রীদের মুখে উপহাস শোনা যেত। কেউ কেউ বলতেন, দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েই ছিল। সেটার বহিঃপ্রকাশ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। উপলক্ষ তৈরি করে দেয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এর আগেও ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) আন্দোলনে (২০১৫) যার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন লাগাতারভাবে শুরু হয় গত ১ জুলাই। ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’সংক্রান্ত এক বক্তব্য ও শিক্ষার্থীদের দাবিকে আইন-আদালতের চক্করে ফেলার পর তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে এসে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’
বাংলাদেশে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস কেউ পায়নি। নিবর্তনমূলক আইন, গুম, গ্রেপ্তার, হয়রানি ও চাপের মুখে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম ছিল কোণঠাসা। এর বিপরীতে শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিলেন। শুরু হলো সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নতুন যাত্রা। কন্ঠে কন্ঠে ধ্বনি উঠলো ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। এই স্লোগানে উজ্জীবিত ঘরে ঘরে মায়েরা যারা রাস্তায় নামতে পারেনি তারা স্বৈরাচারের পতন কামনা করে রোজা রেখেছেন, জায়নামাজে নফল নামাজের সেজদায় লুটিয়ে পড়েছেন। অনেক মা সন্তানদেরকে স্বামীর নিকট জিম্মা রেখে রাস্তায় নেমেছেন। পরের দিন সেই মা নিজের সন্তানদেরকে ঘরে আগলে রেখে স্বামীকে রাস্তায় পাঠিয়েছেন। রাজপথে নেমে আসা মায়েরা, ছেলেদের মাথায় হাত দিয়ে বলেছে তোমরা আমার সন্তান। জবাবে রাজপথের সৈনিকরা বলেছেন, এরকম সাহসী মা পেলে আমরা শুধু বাংলাদেশ নয়, করবো বিশ্বকে জয়।
‘তাঁর দম্ভ দলটাকে ধ্বংস করল’: আওয়ামী লীগের বয়স ৭৫ বছর। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরে বাদ দেওয়া হয় মুসলিম শব্দটি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী কিছু সেনা কর্মকর্তার হাতে সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে আওয়ামী লীগ অনেকটা ছন্নছাড়া হয়ে যায়। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। ক্ষমতায় এসে সেই আওয়ামী লীগই ২০১৪ সালের নির্বাচন করেছে বিরোধী দলের বর্জনের মুখে। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিত পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ভোটে মাঠে বিরোধী দল বিএনপি ছিল না। আওয়ামী লীগ নিজেদের দলের লোকদেরই ‘ডামি’ প্রার্থী করে ভোটের আয়োজন করে।
শেখ হাসিনা দলের ভেতরে নিজের ন্যূনতম বিরোধিতা এড়াতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করা নেতাদের কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। সামনে এনেছিলেন অনুগত নেতাদের। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, পুলিশ ও আমলানির্ভর, দুর্নীতিবাজে ঘেরা একটি দল।
শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিলেন। পরে তিনিই পরিচিত হন গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে। শেখ হাসিনা সারের জন্য কৃষক খুন নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর ওপর এখন ছাত্রহত্যার দায়। পাঁচ শতাধিক ছাত্র-জনতার গণহত্যার দায় নিয়ে ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা বিদায় নিয়েছেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, এরশাদের চেয়ে শেখ হাসিনা শত গুণ বেশি খারাপ হয়ে বিদায় নিয়েছেন। এরশাদ পালিয়ে যাননি। তিনি পালিয়ে গেছেন। তিনি পালিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগ দলটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। তাঁর হিংসা, দম্ভ, অহংকার দলটাকে ধ্বংস করেছে।
’৫২ থেকে ’২৪। উনিশ’শ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের মানুষ ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের মতো এত মৃত্যু দেখেনি। অতীতের আন্দোলনের মতো এবারের আন্দোলনেও সামনের সারিতে ছিলেন শিক্ষার্থীরা। এবারের বিশেষ দিক ছাত্রীদের, নারীদের বড় অংশগ্রহণ। আরেকটি দিক হলো, এবার লড়াই হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। বেশির ভাগ গণমাধ্যম ও টেলিভিশন চ্যানেল যখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে, অনলাইন মাধ্যমগুলো চাপে, তখন শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ ও আন্দোলনের আদর্শিক লড়াইয়ের পথ হয়ে ওঠে ফেসবুক, টুইটার। সেখানে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ, স্বজন হারানোর বেদনা, পুলিশের গুলি করার ভিডিও চিত্র। তাতে যুক্ত করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের গান, দেশপ্রেমের গান। নতুন নতুন স্লোগান, তৈরি হয় দেয়াললিখনও। এবারের গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল ‘জেনারেশন জেড’, যারা সংক্ষেপে ‘জেন জি’ নামে পরিচিত। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ এই প্রজন্ম তাদের লড়াই তাদের মতো করে করেছে। তাদের ঠেকাতে বারবার ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। কখনো কখনো ইন্টারনেট চালু থাকলেও বন্ধ রাখা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তবে শিক্ষার্থীদের দমানো যায়নি। বিস্ময়করভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন আক্রান্ত হয়, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। অতীতের আন্দোলনে সভা-সমিতির মাধ্যমে সংঘবোধ তৈরি হতো। নতুন প্রজন্ম সেটা তৈরি করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্য দিয়ে। মোটাদাগে দুটি বড় সমস্যায় তাঁরা ভুগছেন, গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা ও শোভন কর্মসংস্থানের অভাব। পাশাপাশি অনলাইন জগতে তাঁরা যেহেতু বিশ্বনাগরিক, সেহেতু তাঁরা আইনের শাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচারের অভাব বোধ করেন।
এতো কিছুর পরেও বলতে দ্বিধা নেই, একজন সরকারপ্রধানের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের সমস্যাগুলো মিটে যাবে বলে মনে করি না। তাই নতুন সরকারকে তরুণদের প্রত্যাশাগুলো পূরণে কাজ করতে হবে।’
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম ফিরে আসি সেই কথায়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে জন্ম নিয়েছে ‘বাংলা বসন্ত’। আনন্দের উল্লাসকে পুঁজি করে একটি সুদুর প্রসারী স্বার্থান্বেষী মহল সর্বত্র ভাঙছে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। শুধু ভেঙেই খ্যান্ত হচ্ছেনা, জাতির জনককে তারা করছে অসম্মানিত। অথচ ম্যুরাল হল একটি চিত্রকলা, যা দেওয়াল, ছাদ বা অন্যান্য স্থায়ী পৃষ্ঠতলগুলিতে আঁকা হয় বা স্থাপন করা হয়। ম্যুরাল চিত্রকলার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল প্রদত্ত স্থানটির স্থাপত্য উপাদানগুলি সাদৃশ্যপূর্ণভাবে ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আর তাই এই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের অগ্রসৈনিকদের কাছে নিবেদন, ‘বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করবেন না। তিনি এই জাতিকে দিয়েছেন বিজয়, যিনি বিজয়ের নায়ক, তাঁর স্থান সব সময় অনেক ওপরে। সেই বিজয়ের নায়ক বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করলে কলঙ্কিত হবে জাতি’। আমরা বাংলাদেশী বাঙালী। বাঙলা আমার ভাষা। বাঙলা আমার প্রাণ। সেই প্রাণের স্পন্দন ‘বায়ান্নয়’ স্তব্দ করতে পারেনি। জয় হোক সমগ্র বাংলাদেশী বাঙালীর।