নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং দলটির প্রয়াত নেতা কর্নেল তাহেরও জড়িত বলে সরাসরি অভিযোগ করলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তত্কালীন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানও ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের এই জ্যেষ্ঠ নেতা।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে বুধবার রাজধানীর তোপখানা রোডে বিএমএ ভবনে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ইনু-তাহের এবং শফিউল্লাহ-জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার এই অভিযোগ করেন শেখ সেলিম।
তবে শেখ সেলিমের বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়’ দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। বৃহস্পতিবার ইনু ইত্তেফাককে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আপন মামা বঙ্গবন্ধু ও আপন ভাই শেখ মনির লাশ ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সঙ্গে যুক্ত তৎকালীন আমেরিকার দূতাবাসে গিয়ে শেখ সেলিম কী করছিলেন, তা জাতি জানতে চায়।’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে শেখ সেলিম ও হাসানুল হক ইনু এমন বক্তব্য রাখলেও দুই জনই এই হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর ঘটনা উদঘাটনে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
বিএমএর আলোচনাসভায় শেখ সেলিম বলেন, ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট ব্রিগেড কমান্ডারদের কেউ বঙ্গবন্ধুর লাশটা দেখতে যায়নি। সবাই রেডিও স্টেশনে গেছে। সেদিন যারা রেডিও স্টেশনে গেছে তারা সবাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। খুনিদের সমর্থন করতে তারা গিয়েছিল। ইনু-তাহের, যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিল, তারাও গিয়েছিল খুনিদের সমর্থন করতে। বঙ্গভবনে গিয়ে তারা খুনি মোশতাককে অভিনন্দন জানিয়েছিল। মোশতাকের সরকারকে তারা অভিনন্দন জানায়। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার পর আর তাদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নেই। বঙ্গবন্ধু যেদিন মারা যান, সেই দিনই তাদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র শেষ। সিরাজ সিকদারের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ ছিল।’
শেখ সেলিমের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে ফাটল ধরাতেই এসব কথা বলছেন শেখ সেলিম। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে যেভাবে আমাদের নাম উল্লেখ করে বলা হচ্ছে তাতে প্রকৃত খুনিরা এবং ষড়যন্ত্রকারীরা আড়ালে যায়। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করব—‘আপনার কাছের লোকেরাই খন্দকার মোশতাকের ভূমিকায় এখনো আছে যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ঐক্য চায় না। আওয়ামী লীগে মোশতাকের মতো লোকরাই এসব কথা বলছেন। তাছাড়া কথিত ওয়ান-ইলেভেনের সময় এই শেখ সেলিম মাইনাস-টু’র পক্ষে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন সেটিও মানুষ ভুলে যায়নি।’
এদিকে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জাসদকে জড়িয়ে শেখ সেলিমের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি। বৃহস্পতিবার জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির পক্ষ থেকে দলটির দপ্তর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শেখ সেলিম বঙ্গবন্ধুর খুনি গোষ্ঠী ও খুনি গোষ্ঠীর পাকিস্তানপন্থার রাজনীতির ধারকদের আড়াল করার উদ্দেশ্যেই মিথ্যাচার করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস পেয়েছেন। জাসদ কখনোই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করেনি। জাসদ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সুফলভোগীও নয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন—‘দূরের না, আপন লোকরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। আমার মা যাদের রেঁধে খাওয়াতেন তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে।’
জাসদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার এজাহার, এফআইআর, তদন্ত, চার্জশিট, সাক্ষীদের জেরা ও সওয়াল জবাব, চার্জের ওপর আদালতে যুক্তিতর্ক, আদালতের রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণের কোথাও জাসদ বা জাসদের কোনো নেতার নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। জাসদ গঠন ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্তি বঙ্গবন্ধুকে দুর্বল করে দিয়েছিল, একা করে দিয়েছিল, অসহায় করে দিয়েছিল—এটা সত্য। কিন্তু যারা জাসদ গঠন করেছিলেন তারা জাসদ গঠনের আগে বঙ্গবন্ধুকে তার নেতৃত্বে বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এমনকি ছাত্রলীগের বিভক্তি, ১৯৭২ সালের ২১, ২২ ও ২৩ জুন একই দিনে দুই জায়গায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সম্মেলনের একটিতে বঙ্গবন্ধুর যোগদানের পরও ৩১ অক্টোবর জাসদ গঠনের আগ পর্যন্ত কয়েক মাস তারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। কাদের চাপে বঙ্গবন্ধু বিভক্তির পথে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকেও বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল—তাও আজ জাতির সামনে প্রকাশিত। সুতরাং জাসদ গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্ত করার দায়ও জাসদের না, বরং ঐ ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীরই। এই ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্ত করে বঙ্গবন্ধুকে একলা ও অসহায় করে চাটার দল, চোরের খনির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।’