নিজস্ব প্রতিবেদক : আমানত সংকট, ঋণ কেলেঙ্কারি, সুদহার কমিয়ে আনাসহ নানা কারণে বছরজুড়ে ব্যাংক খাত ছিল আলোচনা সমালোচনার শীর্ষে। এক ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারায় বেশির ভাগ ব্যাংকের আমানতে টান পড়ে। তাতে সংকটে পড়ে পুরো ব্যাংক খাত। বছরজুড়ে এরকম আলোচনা সমালোচনার পরেও দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। তবে খেলাপি ঋণের উল্লম্ফন ম্লান করেছে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার কৃতিত্ব। আমদানির চাপ সামলাতে গিয়ে হিমসিম খায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে টান পড়ে রিজার্ভে। বছরের শেষ ভাগে রিজার্ভ নেমে আসে ৩১ বিলিয়নে। তবে শেষ পর্যন্ত জাপান টোব্যাকো (জেটি) ) গ্রুপের ৫৬ কোটি ডলার রিজার্ভে যোগ হওয়ায় বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার বর্তমানে ৩২ মিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগে এক ডজন ব্যাংককে শোকজও করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, জাপানি তামাক কোম্পানি জাপান টোব্যাকো (জেটি) গ্রুপ নভেম্বরের শেষে বাংলাদেশে আকিজ গ্রুপের মালিকানায় থাকা ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেডকে (ইউডিটিসি) ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারে কিনে নিয়েছে। ঐ অর্থের মধ্যে ৫৬ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যোগ হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে প্রবাসীরা ৬২৮ কোটি ৬২ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। আর ডিসেম্বর মাসের গত বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত রেমিটেন্স ১০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছে। সর্বশেষ রিজার্ভের পরিমান দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। অর্থবছরের শুরুর মাস জুলাইতে রিজার্ভ ছিলো ৩২ হাজার ১০৫ মিলিয়ন ডলার। আগস্টে ছিলো ৩২ হাজার ৯২৬ মিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরে কমে হয় ৩১ হাজার ৯৫৭ মিলিয়ন ডলার। অক্টোবরে আবার বেড়ে হয় ৩২ হাজার ৭৮ মিলিয়ন ডলার। নভেম্বরে ১ মিলিয়নের চেয়েও বেশী কমে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৫৬ মিলিয়ন ডলারে। গতবছর ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভের পরিমান ছিলো ৩৩ হাজার ২২৬ মিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হয়। সেই হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। এবার নির্বাচনের বছর হওয়ায় গত কয়েক মাস রপ্তানির বিপরীতে আন্ডার ইনভয়েস এবং আমদানির নামে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে।‘আমদানির চাপ থাকলেও সম্প্রতি রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। রফতানি প্রবৃদ্ধিও ভালো। ফলে রিজার্ভ আবারও রেকর্ড পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফারমার্স ব্যাংক পুরো খাতে সংকট তৈরি করার পর ব্যাংকটিকে বাঁচাতে সরকারের নির্দেশে এগিয়ে আসে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক ও একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান। মূলধন সহায়তা ও বন্ড ক্রয়ের মাধ্যমে ব্যাংকটিকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি পরিচালনারও দায়িত্ব নেয় তারা। জনতা ব্যাংকে অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ জালিয়াতি নিয়ে পুরো খাতই ছিল আলোচনায়। ফলে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। তাতে মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে।
এসব টানাপড়েনের মাঝেও দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামাল হোসেন বলেন, প্রথমবারের মতো ১ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা পেয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকও প্রায় ৪৭৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। ৭০০ কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা পেয়েছে এক্সিম ব্যাংক।
ফারমার্স ব্যাংক ছাড়া ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোও। মধুমতি ব্যাংক চলতি বছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। লুটপাটের শিকার হওয়া বেসিক ব্যাংক চলতি বছর বড় অংকের পরিচালন লোকসান গুনেছে। তবে খেলাপি ঋণ থেকে আদায় বাড়ায় ভালো করেছে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত সোনালী ব্যাংক। এই ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, এবছর ব্যাংকটি প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক চলতি বছর প্রায় ৯০০ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। রূপালী ব্যাংকের এমডি মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংক। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) পরিচালন মুনাফা পেয়েছে ১১৬ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের এমডি মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, আমানতের সুদহার নিয়ে টানাহেঁচড়ার কারণে আমাদের প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। এখনো ব্যাংকের হিসাবায়ন চূড়ান্ত হয়নি। মূলধন ঘাটতি থেকে বের হয়ে আসতে বন্ড ছাড়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে।
বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফায় প্রবৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ব্যাংকগুলোর হিসাবায়ন চূড়ান্ত না হওয়ায় এখনই তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন শীর্ষ নির্বাহীরা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে ইসলামী ব্যাংক, পূবালী, ডাচ্-বাংলা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ব্যাংক এশিয়া, যমুনা, ন্যাশনাল, ইউসিবি, প্রাইম, ব্র্যাক, প্রিমিয়ার, ইস্টার্ন ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী বলেন, পূবালী ব্যাংক প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। পরিচালন মুনাফার প্রকৃত হিসাব পেতে আরো ক’দিন অপেক্ষা করতে হবে।
পরিচালন মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হলেও খেলাপি ঋণের লাগামহীন গতি পুরো অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বছরের শেষ তিন মাসে ঋণ খেলাপির খাতায় আরো বড় অংক যোগ হয়েছে। বছর শেষে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে গত এক মাসে বিপুল অংকের ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট নিয়েও অনেক খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও সীমাহীন উদারনীতি গ্রহণ করেছে।
- Home
- এক্সক্লুসিভ
- বছর শেষে ভালো মুনাফা পেয়েছে ব্যাংকগুলো তবে খেলাপিঋণের কারণে সব অর্জন ম্লান হয়ে গেছে