নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : বন্ড জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে গড়ে উঠেছে একটি বড়ো সিন্ডিকেট। তালিকায় আছে শতাধিক গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান। সিন্ডিকেটে জড়িত তিন জন বড়ো মাপের ব্যবসায়ী এখন গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। যে কোনো মুহূর্তে তারা গ্রেফতার হবেন।
জানা গেছে, বন্ড জালিয়াতিতে কারা কারা জড়িত এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটন করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিষয়টি সরকারের হাইকমান্ডকে জানানো হয়েছে। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এই নির্দেশনা পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ইসলামপুর থেকে বন্ড জালিয়াতি চক্রের দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ইসলামপুর হলো বন্ড জালিয়াতি চক্রের প্রধান স্থান। এখান থেকে চোরাই পণ্য সারাদেশে সরবরাহ করা হয়।
ঢাকা বন্ড কমিশনার হুমায়ুন কবির জানান, বন্ড জালিয়াতি চক্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। আমরা জড়িতদের অব্যশ্যই গ্রেফতার করব। দুই জন ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে যাদের নাম বেরিয়ে আসবে তাদেরও গ্রেফতার করা হবে। বন্ড জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে একশ্রেণির কাস্টমস কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জড়িত।
রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা পুনঃরপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানির সুযোগ পায়। বন্ড লাইসেন্সের নামধারী চোরাকারবারি ব্যবসায়ীরা সে সুযোগের অপব্যবহার করে শুল্কমুক্ত পণ্য ফ্রি-স্টাইলে বিক্রি করছেন কালোবাজারে। এতে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। বন্ড বা রাজস্ব খাতে অনিয়ম রোধে নানা বিভাগ, সংস্থা থাকলেও এ পুকুর চুরি এখন প্রকাশ্যে। ফলে প্রতি বছরই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে অর্থ পাচারের পরিমাণ। ২০১৪ সালে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিদেশে যে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন, তাতে কমপক্ষে ২৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করে এনবিআর।
জানা গেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানির শর্তে আমদানি করা পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি, আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা, কম দামে কেনা পণ্যের বেশি মূল্য দেখানো, আবার বেশি দামে বিক্রি করা পণ্যের দাম কাগজপত্রে কম দেখানো ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বিশাল অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি এবং অর্থ পাচার করছেন বন্ড লাইসেন্স নামধারী অসত্ ব্যবসায়ীরা। এসব অসাধু ব্যবসায়ী শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা কাপড়, প্লাস্টিক দ্রব্য, কাগজপণ্য, ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, কার্ড বোর্ড, প্রিন্টিং ইঙ্ক ইত্যাদি দ্রব্য ও বিভিন্ন পণ্য উত্পাদনের কাঁচামাল খোলা বাজারে বিক্রি করছেন।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, পোশাকশিল্প মালিকদের এ আচরণে এনবিআর হতাশ। আমাদের পোশাকশিল্পের উন্নতি হয়েছে শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে। কিন্তু পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু অসত্ ব্যবসায়ী এ সুযোগের অপব্যবহার করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে এনবিআর সতর্ক।
পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) এক শীর্ষ নেতা জানান, ‘আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাপড় আমদানির সুযোগ পাই মূলত: পুনঃরপ্তানির শর্তে, খোলা বাজারে বিক্রির জন্য নয়। তার পরও যারা এ অপরাধ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে শুল্ক প্রশাসনকে আরো সক্রিয় হতে হবে। পাশাপাশি শুল্ক প্রশাসন এ বিষয়টির সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে অভিযোগ করলে বিজিএমইএ অভিযুক্ত পোশাক কারখানার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
শুল্কমুক্ত আমদানিতে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধাপ্রাপ্ত রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ তথ্যমতে, চট্টগ্রাম ছাড়া কেবল ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন মোট ৬ হাজার ২৭০টি বন্ড লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে পোশাকশিল্পে ৪ হাজার ৭২টি লাইসেন্স থাকলেও বর্তমানে সক্রিয় আছে ২ হাজার ৪৩৮টি কারখানা। আর নিষ্ক্রিয় হচ্ছে ১ হাজার ৮৩৪টি পোশাক কারখানা। এসব কারখানার মধ্যে ১ হাজার ৬৯৭টি পোশাকশিল্পের ৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার রাজস্ব জালিয়াতি ধরা পড়েছে। শুল্ক ফাঁকির অপরাধে ৪ হাজার ১১৩ কোটি টাকা জরিমানা করে ২ হাজার ৪২৯টি কারখানাকে বহিষ্কার করেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধার আড়ালে আমদানির শর্ত ভঙ্গ করে চোরাকারবারিতে জড়িত ব্যবসায়ীদের এ অভিনব প্রতারণার দায়ে ১৩২টি পোশাক কারখানা ও তাদের প্রায় ২০০ পরিচালকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এ ১৩২টি কারখানার কাছে শুল্ক ফাঁকি বাবদ ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের পাওনা ৪১৫ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ৩০২ টাকা। ব্যাংক হিসাব জব্দ হওয়া এ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধার আওতায় পণ্য আমদানি করে তা খোলা বাজারে বিক্রি করত। বন্ড লাইসেন্স সুবিধার অপব্যবহার করে এই নামধারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ পাচারের সঙ্গেও জড়িত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের তথ্যমতে, বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার আওতায় রপ্তানির নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় অবাধে কাঁচামাল আমদানি হয়েছে দিনের পর দিন। প্রতি বছর শুধু আমদানি পর্যায়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি শুল্ক-কর অব্যাহতি দিয়ে থাকে সরকার। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) অব্যাহতির হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হলে এর পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। অথচ রপ্তানি অনেক দূরের কথা, ঐ সব আমদানিকারকের কারখানা বা প্রতিষ্ঠানেরই কোনো অস্তিত্ব নেই। বন্ড লাইসেন্স পাওয়া এসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যাই বেশি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব ছাড় দিয়ে আমদানি করা পণ্য যাতে খোলা বাজারে বিক্রি না হয়, তা প্রতিরোধ করতে প্রয়োজনীয় জনবল নেই ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে। বন্ড জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা এত ক্ষমতাশালী যে, কোনো কাস্টমস কর্মকর্তা তাদের পণ্য আটক করলে ঐ কর্মকর্তাকে তারা বদলি করে দেয়। সাম্প্রতিককালে নারায়ণগঞ্জে একটি নিটিং ফ্যাক্টরি কালোবাজারে পণ্য বিক্রি করার সময় হাতেনাতে এক কর্মকর্তা আটক করেন। ঐ ব্যবসায়ীর এক টেলিফোনে তাকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। এমনকি পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিও তারা তোয়াক্কা করে না। তারা এখন ফ্রিস্টাইলে জালিয়াতি করে আসছে। তাদের দাপটে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এক ধরনের অসহায়।