বর্তমানে নিট রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার

ধ্বস ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনছে

গাজী আবু বকর : গত এক সপ্তাহে রিজার্ভ থেকে ১২০ মিলিয়ন ডলার ঝরে পড়েছে। ফলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রিজার্ভ বাড়াতে ডলার খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তারই অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ধ্বস ঠেকাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনছে। গত বৃহষ্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে হিসাবকৃত তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ নিট রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। দেশে বর্তমানে স্থানীয় বিনিয়োগসহ মোট গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৫০২ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। যা এক বছর আগে ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর তারিখে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ৩৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ৩৮৫ কোটি ১৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৩০ জুন গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ১২০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত ৩১ অক্টোবর গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ২৬ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৬৪৮ কোটি ৯ লাখ ডলার। এর আগে, ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কিন্তু, বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় রিজার্ভ কমতে শুরু করে এবং তা অব্যাহত আছে। ফলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত দেড় বছর যাবৎ ঘাটতি মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, গত ১ জুলাই থেকে ২৮ নভেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে ৫ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সময়ে প্রতি কার্যদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে গড়ে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য বেশিরভাগ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মার্কিন ডলারের ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে রেকর্ড ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রিজার্ভ বাড়াতে ডলার খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই ডলার ঘাটতিতে থাকায় তারা এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত গত সোম ও মঙ্গলবার আর্থিক সংকটে থাকা ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭ কোটি ডলার কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ইসলামী ব্যাংক এমন এক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করেছে যখন আমদানির জন্য এলসি খুলতে ব্যাংকটি হিমশিম খাচ্ছে। গত ১ থেকে ২৪ নভেম্বরের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে রেমিট্যান্স এসেছে ২৮ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রায়শ নূন্যতম তারল্যের স্তর বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়া শরিয়াহভিত্তিক এই ব্যাংকটি ডলারপ্রতি প্রায় ১১৬ টাকায় রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে। এটি বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেডা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) অনুমোদিত ডলারের সর্বোচ্চ হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক নির্দেশে এই সংগঠন দুটি ডলারের হার নির্ধারণকারী করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার বিক্রি করে ইসলামী ব্যাংক সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা লোকসান দেয়। দেশের ৬১টি তালিকাভুক্ত বা তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকের জন্য এটি বিশাল ধাক্কা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রিজার্ভ এত দ্রুত কমে গেলে জাতীয় নির্বাচনের আগে জনগণ নেতিবাচক বার্তা পাবে।’ তাই রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনতে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায়, তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়। সম্প্রতি বৈশ্বিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বৈদৈশিক মুদ্রায় টান পড়ে। সেই সাথে কমতে থাকে প্রবাসী আয়। সরকারের জ্বালানি, খাদ্য আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয় রিজার্ভ থেকে। এর ফলে আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকে রিজার্ভ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। এ সংকট দিন দিন বাড়ছে। বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচকটি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ‘আইএমএফ’ বেশকিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে পায় বাংলাদেশ। এই শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে তা ২ হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ ডলারে রাখার কথা ছিল। কিন্তু পরে এসব শর্ত শিথিল করেছে সংস্থাটি। তারপরও প্রত্যাশিত রিজার্ভ রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। চলতি ডিসেম্বরে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাবার কথা রয়েছে।

Share