বিসিএসে চাকরি পেয়ে টাকার মেশিন হয়ে যান আরডিসি নাজিম

নিজস্ব জেলা প্রতিবেদক : সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের নির্যাতক কুড়িগ্রামের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দীন এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।

জানা গেছে, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান নাজিম মূলত বিসিএসে চাকরি পেয়ে বদল যান। অল্প বয়সেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান।

নাজিম উদ্দীন যশোরের মনিরামপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের মৃত নিছার আলীর ছেলে।

তার গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাজিমের দরিদ্র বাবা অসুস্থ্য হয়ে মারা গেছেন তিন বছর আগে। নিছার উদ্দিন অনেক কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বাবার পাশাপাশি তার মা মাজেদা বেগমও অনেক কষ্ট করেছেন। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে নাজিম বড়।

স্থানীয়দের চাঁদার টাকায় পড়াশোনা করা নাজিম উদ্দীন ৩৩তম বিসিএসে চাকরি পেয়ে নিজেকে বদলে ফেলেছেন। এই অল্প বয়সেই কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

দিনমজুর পিতার সন্তান নাজিম উদ্দীন যশোরের মনিরামপুর পৌরশহরে ৮ শতক জামির ওপর স্ত্রী সাবরিনা সুলতানার নামে ৫ তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করছেন। এরই মধ্যে চার তলার কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে পৌরশহরে আরও অনেক জমি কেনার খোঁজ মিলতে শুরু করেছে।সরেজমিন কাশিপুর গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মনিরামপুর পৌর এলাকার ৯৩ নম্বর গাংড়া মৌজার ৫৯৬ নম্বর দাগের (আরএস চূড়ান্ত) ২৫ শতক জমির মধ্যে ১৪.৬৯

শতাংশ জমি ৪৬ লাখ টাকায় ক্রয় করেন তিনি। জমিটি গাংড়া গ্রামের আকবর আলীর কাছ থেকে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই তার শ্বশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক (অব.) আবদুর রাজ্জাকের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়।

জানতে চাইলে আকবর আলী জানান, স্থানীয় মোসলেম উদ্দীনের মধ্যস্থতায় ৪৬ লাখ টাকায় তিনি ওই জমি বিক্রি করেন, যা আবদুর রাজ্জাকের জামাই ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দীন কিনেছেন। কিন্তু দলিল করা হয় নাজিম উদ্দীনের শ্বশুর আবদুর রাজ্জাকের নামে।

মনিরামপুর ৯৪ নম্বর মৌজায় ৮৩ খতিয়ানের ১৩২ নম্বর দাগের ( আরএস চূড়ান্ত) ৩২.২৫ শতকের মধ্যে ৮ শতক জমি ১৩ লাখ টাকায় কেনা হয়, যা উপজেলার কাজিরগ্রামের মোকলেছুর রহমানের কাছ থেকে ৬ শতক এবং তার স্ত্রী মোছা. নাজমুন নাহার রুপার কাছ থেকে ২ শতকসহ ৮ শতক জমি নাজিম উদ্দীনের স্ত্রী সাবরিনা সুলতানার নামে ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রেজিস্ট্রি করা হয়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, রেজিস্ট্রিকৃত জমি নাজিম উদ্দীনের স্ত্রী সাবরিনা সুলতানার নামে হলেও সেখানে স্বামীর নাম না দিয়ে তার বাবা (নাজিম উদ্দীনের শ্বশুর) আবদুর রাজ্জাকের নাম দেয়া হয়েছে। এই জমির ওপরই নির্মাণ করা হচ্ছে পাঁচতলার বিশাল অট্টালিকা।

সরেজমিন সেখানে গেলে কর্মরত শ্রমিক লিটন হোসেন জানান, এক বছর ধরে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ভবনটি নির্মাণ করছেন জনৈক শহিদুল ইসলাম শহিদ নামের কন্ট্রাকটর। এক প্রশ্নে লিটন জানায়, ভবনটি নাজিম উদ্দীন নির্মাণ করছেন।

আতিয়ার রহমান নামের রাজমিস্ত্রি জানান, এ পর্যন্ত দেড় কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এসব বিষয়ে নাজিম উদ্দীনের দাবি, তার শ্বশুর পেনশনের টাকা দিয়ে গাংড়া মৌজায় জমি কিনেছেন। আর শ্বশুরের কিনে দেয়া স্ত্রী সাবরিনা সুলতানার নামে ৮ শতক জমির ওপর ভবনটি প্রবাসী শ্যালিকা নির্মাণ করছেন।

তবে তার কথার অমিল পাওয়া যায় উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে গেলে। ওই অফিস সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ১ মার্চ অবসরে যান নাজিম উদ্দীনের শ্বশুর আবদুর রাজ্জাক। অবসরের ৪ দিন পর পেনশনের ৮ লাখ ১৭ হাজার ৬০০ টাকা উত্তোলন করেন তিনি।

জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, পেনশনের এই টাকা দিয়ে ৮ বছর পর কীভাবে তিনি ৪৬ লাখ টাকায় জমি কিনলেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হলে টাকার উৎস সম্পর্কে সত্য উদ্ঘাটন হবে বলে অনেকে মনে করেন।

গত শুক্রবার মধ্যরাতে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নির্দেশে সিনিয়র সহকারী কমিশনার (রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর) নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৪০ জনের একটি দল আরিফুল ইসলামের বাসার দরজা ভেঙে ঢুকে তাকে মারধর করে প্রথমে এনকাউন্টার দেয়ার (গুলি করে হত্যা করার) হুমকি দেয়।

সেখান থেকে তাকে তুলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে চোখ বেঁধে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়। এরপর সাজানো মামলায় ৪৫০ গ্রাম দেশি মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা সঙ্গে দিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় আরিফকে। চোখ বাঁধা অবস্থাতেই চারটি কাগজে স্বাক্ষরও করতে বাধ্য করা হয় তাকে।

এ ঘটনায় গতকাল সোমবার কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এবং জেলা প্রশাসনের তিন কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী কমিশনার নাজিম উদ্দিন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু কান্তি দাশ ও এস এম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে।

Share