বেঁচে থাকলে রাসেলের আজ ৫৭ হতো

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেই কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদেরও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের মর্মান্তিক এই হত্যাযজ্ঞে পাষণ্ড খুনিদের হাত থেকে রেহাই পায়নি নারী ও শিশুরাও। সেদিন মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত।

ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শেখ রাসেল যখন শহীদ হন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। অথচ নিষ্পাপ, নিরপরাধ অতটুকু শিশুকে হত্যা করতেও সেদিন খুনিচক্রের বুক কাঁপেনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র শহীদ শেখ রাসেলের ৫৭তম জন্মদিন আজ রোববার। ১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে তার জন্ম।

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা শেখ রাসেলকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। তাদের সেই অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে। শহীদ শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ ও শুভবুদ্ধি বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে ভালোবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ ও অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে বাংলাদেশ নামক জনপদে শেখ রাসেল আজ এক মানবিক সত্তায় পরিণত হয়েছে। শেখ রাসেলের মর্মান্তিক বিয়োগ-বেদনাকে হৃদয়ে ধারণ করে বাংলার প্রতিটি শিশু-কিশোর ও তরুণের মুখে হাসি ফোটাতে মানবিক চেতনাসম্পন্ন সব মানুষ আজ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

যেভাবে শহীদ হন শেখ রাসেল: ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সংঘটিত নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বেরিয়ে এসেছে ওই ভয়াল রাতের বর্বরোচিত ঘটনার ভয়াবহ চিত্র। তাদের বিবরণ থেকে জানা গেছে, শিশু রাসেল সেদিন দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরে ঘুমিয়েছিলেন বাবা শেখ মুজিবুর রহমান এবং মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে। ভোর ৫টার দিকে খুনি ঘাতকচক্র ওই বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এই সময় বেগম মুজিব জীবন বাঁচাতে শেখ রাসেলসহ পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে দোতলার শোবার ঘরে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে খুনিদের একজন মেজর আজিজ পাশা তার ফোর্সসহ দোতলায় উঠে আসে। তারা বঙ্গবন্ধুর কক্ষের দরজা ধাক্কাধাক্কি করে সেটি খোলার জন্য বললেও বেগম মুজিব প্রথমে তা করেননি। ঘাতক সেনারা দরজায় গুলি করতে শুরু করলে দরজা খুলে দিতে বাধ্য হন তিনি।

এরপর ঘাতকরা বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসের এবং অন্য এক পরিচারককে নিচে নামিয়ে আনে। বেগম মুজিব সিঁড়ির নিচে শেখ মুজিবের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওই সময় বেগম মুজিবকে বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরের সামনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে কক্ষের ভেতরে শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী জামালকে হত্যা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এবং বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ কাম রিসিপশনিস্ট আ ফ ম মুহিতুল ইসলামের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ওপরে যখন এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলছিল, তখন নিচে থাকা শেখ রাসেল মায়ের কাছে যাবেন বলে কান্নাকাটি করছিলেন। একই সঙ্গে সেখানে থাকা মুহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, ‘ভাই আমাকে মারবে না তো?’ এই সময় ঘাতকরা মুহিতুল ইসলামকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে শেখ রাসেলকে নিয়ে পুলিশ বক্সে আটকায়। এই সময়ও মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতে থাকলে মেজর আজিজ পাশা ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দেয়। ওই হাবিলদার শেখ রাসেলকে হাত ধরে ‘চল তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই’ বলে দোতলায় নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর ওপর থেকে গুলির আওয়াজ এবং কান্নাকাটি ও চিৎকার শোনা যায়। পরে ওই হাবিলদার নিচে নেমে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলে, ‘স্যার, সব শেষ’।

শেখ রাসেলের লাশ বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরে তার দুই ভাবি সুলতানা কামাল এবং রোজী জামালের মরদেহের মাঝখানে একটি লুঙ্গিতে মোড়া অবস্থায় পাওয়া যায়। তার পরনে ছিল হাফ প্যান্ট। গুলিতে মাথা উড়ে গিয়েছিল। ১৬ আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে রাসেলকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

জন্মদিনের কর্মসূচি: শেখ রাসেলের ৫৭তম জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন দল ও সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আজ সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউল্যাব স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরে শেখ রাসেল মুরালের উন্মোচন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ম্যুরালটি উন্মোচন করবেন।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে রয়েছে আজ সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে শেখ রাসেলসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দিনব্যাপী কোরআনখানি এবং বাদ আসর মিলাদ ও দোয়া মাহফিল করবে। এ ছাড়া মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগ, তাঁতী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের জন্য দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থক ও সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি দলের সব সহযোগী ও শাখা সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

Share