নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত রমনা পার্কে সাধারণ দর্শনার্থীদের ভোগান্তি বেড়েছে। সোমবার দুপুর ১২টায় রাজধানীর রমনা পার্কের প্রধান ফটকে প্রবেশের অপেক্ষায় অর্ধশতাধিক দর্শনার্থী। দায়িত্বরত আনসার সদস্য তাদের বিকেল ৩টার পর আসতে বলেন। আনসার সদস্যকে অনুনয়-বিনয় করেও ঢুকতে না পেরে পরিবার নিয়ে আসা অনেকেই ফিরে যান। এভাবে প্রতিদিন কয়েক হাজার দর্শনার্থী ফিরে যাচ্ছেন। ফটকে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে দেখা গেল, সাধারণ দর্শনার্থীদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হলেও ভিআইপি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবাধে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে।
মহামারি করোনার শুরুতে সাধারণ ছুটির পর পার্কটি বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও পার্ক বন্ধ রাখায় নগরবাসীর তীব্র সমালোচনার মুখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে খুলে দেওয়া হয়। তবে এখনো অচলাবস্থা কাটেনি।
বর্তমানে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন ৯ ঘণ্টা খোলা থাকে পার্কটি। আর ৯টি গেটের চারটিই বন্ধ থাকে সবসময়। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া প্রবেশ করতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঘুরতে আসা মানুষজন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল ৬টা থেকে সকাল ১১টা ও দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত পার্কটি খোলা থাকবে; এমন একটি লেখা পার্কের বিভিন্ন ফটকে ঝুলছে। পার্কটি সন্ধ্যা ৭টায় বন্ধ হওয়ার নিয়ম থাকলেও সব গেট ৮টায় বন্ধ হয়। তবে ভিআইপি গেট খোলা থাকে রাত ১১টা পর্যন্ত। রাতে সাধারণত বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমপি, মন্ত্রীসহ প্রভাবশালীরা হাঁটতে আসেন। স্বাস্থ্যসচেতন অনেকে সকাল থেকেই রমনা পার্কে নির্মল হাওয়ায় ব্যায়াম করেন। কেউ হাঁটেন, কেউ দৌড়ান। কেউ একা, কেউ স্বজনদের নিয়ে, কেউ বা বিভিন্ন সংঘের হয়ে দলবদ্ধভাবে ব্যায়ামে ব্যস্ত। পার্কে স্বাস্থ্যসচেতন নারীদেরও হাঁটতে, দৌড়াতে এবং শরীরচর্চা করতে দেখা গেল।
পার্কে আসা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগের মতো পার্কের ভেতর বখাটেদের উৎপাত নেই, ভিক্ষুকদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
দিনে পার্কটি খোলার এই নির্দিষ্ট সময়েও ৯টি গেটের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আইইবি, হাইকোর্টের বিপরীত পাশের তিনটি গেট এবং কাকরাইল মসজিদের পাশের গেটটি একেবারেই বন্ধ। এসব বন্ধ গেটের সামনে ও আশপাশে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ দোকান বসেছে। মাহমুদুল হাসান নামে একজন এসেছেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। সাড়ে ১২টার দিকে দেখেন গেট বন্ধ। ফিরে যাওয়ার সময় তিনি বলেন, একদিকে শিশু পার্কটি পুরোপুরি বন্ধ, অন্যদিকে রমনাপার্ক প্রায় অর্ধবেলা বন্ধ। মানুষ বিনোদনের জন্য যাবে কোথায়?
ঢাকার বাসিন্দাদের বিনোদন ও এক চিলতে অবসরের জায়গা রমনাপার্ক। ৬৮ দশমিক ৫ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত পার্কটি। ব্রিটিশ আমল থেকেই শহরের বাসিন্দারা বিনোদন, শরীর চর্চা আর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য বেছে নেন অন্যতম সবুজ ভূমিকে।
জানতে চাইলে দায়িত্বরত একাধিক আনসার সদস্য বলেন, ‘উপরের’ নির্দেশে ভিআইপি গেট রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। তখন অনেকে ঘুরতে এসে নিজেদের ভিআইপি বলে পরিচয় দেন। তাদের কেউ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরি করেন, কেউ আবার নিজেদের ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে থাকেন। তখন কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা বিপাকে পড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রমনা পার্কের আধুনিকায়নে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা থাকলেও করোনায় কাজ পিছিয়ে যায়। এ বছরের জুনে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শেষ হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, রমনা পার্ক সবার জন্য উন্মুক্ত। রাতে তো উন্মুক্ত হতে পারে না? রমনা পার্কের পূর্ব দিকের পেছনের সড়কটি রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীসহ কূটনীতিকদের মতো সব ভিভিআইপির যাতায়াতে ব্যবহৃত হয়। এর পেছনে প্রধান বিচারপতির বাসভবন, অন্যদিকে মন্ত্রীপাড়া। আরেক পাশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। সব মিলিয়ে এটি স্পর্শকাতর একটি জায়গায়। অনেক ভিআইপি লোক এখানে হাঁটতে আসেন। পার্কে বেড়াতে আসা যুগলদের প্রতিনিয়ত আপত্তিকর অবস্থায় দেখা যায়। রোমান্টিকতার নামে বেহায়াপনা রোধে সংশ্লিষ্টদের প্রায়ই কঠোর হতে হয়।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মিঠুন মিস্ত্রী জানান, বিশ্বের সব পার্কই ব্যবস্থাপনা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য কিছু সময় বন্ধ রাখে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রমনা পার্কের সব গেট বন্ধ রাখা হয়।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানীর দুই কোটি মানুষের চাহিদা বিবেচনায় উদ্যান ও পার্কের সংখ্যা খুবই কম। আমাদের প্রয়োজনের ১০ ভাগের মাত্র এক ভাগ রয়েছে। এ কারণে পার্কগুলোতে প্রচুর ভিড় থাকে। কোনো খোঁড়া অজুহাত বা যুক্তিতেই পার্ক বন্ধ রাখা যাবে না।
তিনি বলেন, সব গেটই সাধারণ মানুষদের জন্য উন্মুক্ত রাখা উচিত। কিন্তু তা না থাকায় জনগণ ভোগান্তিতে পড়ছেন। আবার ভিআইপি গেট খোলা থাকছে। এখানে ভিআইপিদের আলাদাভাবে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এই বৈষম্যও পরিকল্পনার দিক থেকে অন্যায্য।
তিনি বলেন, ঢাকার সব পার্ক, উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠগুলোর ব্যবস্থাপনায় মনিটরিং জোরদার করতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণের নামে দখল ও তালাবদ্ধ করে নিয়ন্ত্রণ অগ্রহণযোগ্য।