ভুয়া পরোয়ানা ঠেকানোর পথ দেখালেন হাইকোর্ট

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে সাধারণ মানুষই শুধু হয়রানির শিকার হচ্ছেন না, আইনজীবী পর্যন্ত গ্রেপ্তারের নজির রয়েছে। এ থেকে রেহাই পাওয়ার তথা ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঠেকানোর পথ দেখিয়েছেন হাইকোর্ট। এখন থেকে পরোয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, মোবাইল ফোন নম্বর, পদবি ইত্যাদি তথ্য উল্লেখ করতে হবে ফরমে। এতে করে পরোয়ানা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট নম্বরে ফোন করে নিশ্চিত হওয়া যাবে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার ভুয়া পরোয়ানা রোধে এমনই সাত দফা নির্দেশনা দিয়ে আদেশ জারি করেছেন।

ভুল আসামি হিসেবে ৬৮ দিন কারাবাসের পর গণস্বাস্থ্যের কর্মকর্তা আওলাদ হোসেনের করা একটি রিট আবেদনের শুনানিকালে এসব নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। আদালতে আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তার সঙ্গে

ছিলেন এমাদুল হক বশির। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী।

হাইকোর্টের দেওয়া ৭ দফা নির্দেশনাগুলো হলো-

এক. গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যুর সময় পরোয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৭৫-এর বিধান মতে নির্ধারিত ফরমে উল্লিখিত চাহিদা অনুযায়ী সঠিক ও সুস্পষ্টভাবে তথ্য পূরণ করতে হবে। যেমন (ক) যে ব্যক্তি বা যে সকল ব্যক্তি পরোয়ানা কার্যকর করবেন, তার বা তাদের নাম এবং পদবি ও ঠিকানা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। (খ) যার প্রতি পরোয়ানা ইস্যু করা হচ্ছে অর্থাৎ অভিযুক্তের নাম ও ঠিকানা এজাহার নালিশি মামলা কিংবা অভিযোগপত্রে বর্ণিতমতে সংশ্লিষ্ট মামলার নম্বর ও ধারা এবং ক্ষেত্রমতো আদালতের মামলার নম্বর ও ধারা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। (গ) সংশ্লিষ্ট জজ (বিচারক)/ ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরের নিচে নাম ও পদবির সিল এবং ক্ষেত্রমতো দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারকের নাম ও পদবির সিলসহ বামপাশে বর্ণিত সংশ্লিষ্ট আদালতের সুস্পষ্ট সিল ব্যবহার করতে হবে। (ঘ) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তির (অফিস স্টাফ) নাম, পদবি ও মোবাইল ফোন নম্বরসহ সিল ও তার সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর ব্যবহার করতে হবে, যাতে পরোয়ানা কার্যকরকারী ব্যক্তি পরোয়ানার সঠিকতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহের উদ্রেক হলে পরোয়ানা প্রস্তুতকারীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে সঠিকতা নিশ্চিত হতে পারে।

দুই. গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুত করা হলে স্থানীয় অধিক্ষেত্র কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট পিয়নবইতে এন্ট্রি করে বার্তাবাহকের মাধ্যমে তা পুলিশ সুপারের কার্যালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট থানায় প্রেরণ করতে হবে। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের/ থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্তৃক ওই পিয়নবইতে স্বাক্ষর করে তা বুঝে নিতে হবে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রেরণ ও কার্যকর করার জন্য পর্যায়ক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কাজে লাগানো যেতে পারে।

তিন. স্থানীয় অধিক্ষেত্র বাইরের জেলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরকরণের ক্ষেত্রে পরোয়ানা ইস্যুকারী কর্দৃপক্ষ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সিলগালা করে এবং অফিসের সিলমোহর ছাপ দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রেরণ করবেন।

চার. সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের দায়িত্ব¡প্রাপ্ত কর্মকর্তা সিলমোহরকৃত খাম খুলে প্রাপ্ত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পরীক্ষা করে উহার সঠিকতা নিশ্চিত অন্তে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ব্যবস্থা নেবেন। তবে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ক্ষেত্রে সন্দেহের উদ্রেক হলে পরোয়ানায় উল্লিখিত পরোয়ানা প্রস্তুতকারীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে উহার সঠিকতা নিশ্চিত হয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।

পাঁচ. গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরকরণের জন্য পরোয়ানা গ্রহণকারী কর্মকর্তা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রাপ্তি অন্তে তা কার্যকর করার পূর্বে পুনরায় পরীক্ষা করে যদি কোনো সন্দেহের উদ্রেক হয় সে ক্ষেত্রে পরোয়ানায় উল্লিখিত পরোয়ানা প্রস্তুতকারীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে উহার সঠিকতা নিশ্চিত হয়ে পরোয়ানা কার্যকর করবে।

ছয়. গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অনুসারে আসামিকে/আসামিদের গ্রেপ্তারের পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে ওই আসামি/আসামিদের আইন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিকট ম্যাজিস্ট্রেট/ জজ আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ উপস্থাপন করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট/গ্রেপ্তারকৃত আসামি বা আসামিদের জামিন প্রদান না করলে আদেশের কপিসহ হেফাজতি পরোয়ানা মূলে আসামি/আসামিদের জেলহাজতে প্রেরণসহ ও ক্ষেত্রমত সম্পূরক নথি তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যুকারী জজ/ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বরাবর প্রেরণ করবেন।

এবং সাত. সংশ্লিষ্ট জেল সুপার কিংবা অন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেফাজতি পরোয়ানামূলে প্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট আসামি/আসামিদের গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যুকারী আদালতে এই মর্মে অবিলম্বে অবহিত করবেন যে, কোন থানার কোন মামলার সূত্রে বা কোন আদালতে কোন মামলায় বর্ণিত আসামিদের ওই আদালতের ইস্যুকৃত পরোয়ানামূলে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে আসামিদের নতুন কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানাপ্রাপ্ত হলে জেল সুপার ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালত হতে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে পরোয়ানা কার্যকর করবেন।

এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব, আইন সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, মহা-কারাপরিদর্শক ও সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া আদেশের কপি প্রত্যেকটি দায়রা জজ ও মেট্রোপলিটন দায়রা জজ, সব ট্রাইব্যুনাল, বিশেষ জজ আদালতের বিচারক, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

উল্লেখ্য, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে কক্সবাজারের এক মামলায় ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর আওলাদ হোসেনকে আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেদিন আওলাদকে ঢাকার আদালতে হাজির করে তার জামিন চাওয়া হয়। ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (আশুলিয়া) জামিন নামঞ্জুর করে নথিপত্র কক্সবাজারের আদালতে পাঠানোর আদেশ দেন।

কক্সবাজারের আদালতের দেওয়া আদেশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। আদেশ পৌঁছার পর ঢাকা কারাগার থেকে জানানো হয়, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে রাজশাহীর এক মামলায় (১৩৭/২০১৬) আওলাদকে রাজশাহীর আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে। এর পর আওলাদকে রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ট্রাইব্যুনাল ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর আদেশ দেন। এভাবে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বেশ কয়েকটি জেলায় ঘুরে ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন আওলাদ হোসেন।

এ রিটের প্রাথমিক শুনানি করে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। এছাড়া ভুয়া ওয়ারেন্টের বিষয়ে সিআইডিকে তদন্তেরও নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৯ মার্চ হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে সিআইডি। এতে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো জাল-জালিয়াতিপূর্ণ ওয়ারেন্টের ত্রুটিসমূহ অনুধাবন করতে না পারায় ভুয়া ওয়ারেন্টগুলো গ্রহণ ও তামিলে ভূমিকা রেখেছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে পেয়ে হাইকোর্ট এই রিটের ধারাবাহিকতায় গতকাল সাত দফা নির্দেশনা দেন। এছাড়া আওলাদ হোসেনের করা রিট আবেদনটি এখতিয়ার সম্পন্ন অন্য বেঞ্চে শুনানির জন্য উত্থাপন করতে বলেছেন হাইকোর্ট। বর্তমানে এ বেঞ্চের রিট মামলা শুনানির এখতিয়ার না থাকায় হাইকোর্ট এ সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন, জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

Share