ভ্যাট আইন আবারও যাচাই–বাছাই

নিজস্ব প্রতিবেদক : নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের বাকি আছে মাত্র সাড়ে ছয় মাস। আগামী ১ জুলাই থেকে এই আইন চালু করা হবে। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে আবারও নতুন করে আইনটির প্রভাব মূল্যায়নে সমীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সমীক্ষার জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান খোঁজা হচ্ছে।

২০১২ সালে করা আইনটি ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের মাত্র দুই দিন আগে তা দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। এ বাড়তি সময়ের দেড় বছর চলে যাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা এখন আইনটির প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা করার দাবি জানিয়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের দাবি, নতুন আইনটি বাস্তবায়িত হলে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা যেন বাস্তবায়নের আগেই মূল্যায়ন করা হয়। এফবিসিসিআইয়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর এখন সমীক্ষা প্রতিষ্ঠান খুঁজছে।

গত ২৯ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) নতুন ভ্যাট আইনের ওপর প্রভাব মূল্যায়ন করার দাবি জানিয়ে চিঠি দেয় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। এরপর দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের সমীক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছে এনবিআর। এখন ওই সব প্রতিষ্ঠানের জবাবের অপেক্ষায় আছে এনবিআর।

এনবিআরের সদস্য (মূসক নীতি) রেজাউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নতুন আইনটি নিয়ে প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা করব। এখন সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান খুঁজছি। আগামী নির্বাচনের পর আমরা বিষয়টি নিয়ে জোরেশোরে নামব।’

ব্যবসায়ীদের দাবি
এনবিআরে পাঠানো এফবিসিসিআইয়ের চিঠিতে আটটি বিষয়ে প্রভাব মূল্যায়নের দাবি জানানো হয়েছে। প্রথমত, খুচরা ও ভোক্তা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রয়োগের আপতন কেমন হবে; দ্বিতীয়ত, খুচরা ও সেবা খাতের ওপর প্যাকেজ ভ্যাটের পাশাপাশি নির্ধারিত ভ্যাট হার প্রত্যাহারের প্রভাব; খুচরা ব্যবসায়ীদের জন্য ভ্যাট রেয়াত ও প্রত্যর্পণের জন্য হিসাব রাখার বাড়তি খরচের প্রভাব ও জটিলতা; মাঠপর্যায়ে মূসক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা পর্যালোচনা ও করণীয় নির্ধারণ করা; পুরোনো ও নতুন আইনের মৌলিক পার্থক্য চিহ্নিত করা; আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, টার্নওভার, ব্যবসায়ী পর্যায় ও সেবা খাতের ক্ষেত্রে নতুন আইনের রাজস্ব পর্যালোচনা ও প্রভাব বিশ্লেষণ; ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, ব্যবসা ও সেবা খাতের ওপর দুই আইনের প্রভাব বিশ্লেষণ; নতুন আইনের সংশোধনী ধারা চিহ্নিত করা এবং কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নির্ধারণ করা।

ব্যবসায়ীদের দাবি সম্পর্কে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, এটি আসলে আইনটির বাস্তবায়ন আরও পেছানোর পাঁয়তারা। যখন আইনটি পাস করা হয়, তখন একটি প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা করা হয়েছিল। সেটি এখনো প্রাসঙ্গিক আছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এফবিসিসিআই নতুন করে প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা করার দাবি জানিয়েছে, প্রয়োজন হলে তা আবারও করা যেতে পারে। তবে যথাসময়ে ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়নে এনবিআরের যথেষ্ট সদিচ্ছা থাকতে হবে।

এর আগে গত অক্টোবর মাসে মাঠপর্যায়ের ভ্যাট কার্যালয়ের কাছে নতুন আইনের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব চেয়েছিল এনবিআর। কিন্তু এখন পর্যন্ত সব কমিশনারেটের সংশোধনী প্রস্তাব পায়নি এনবিআর। নতুন আইনে অটোমেশন ব্যবস্থায় ভ্যাট আদায় করা হবে। তাই মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুন আইনে কী ধরনের সংশোধনী আনা যেতে পারে, সেই বিষয়ে মতামত আকারে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে।

বাস্তবায়নে সময় লাগবে : নতুন ভ্যাট আইন পুরোপুরি বাস্তবায়নে আরও কয়েক বছর সময় লাগতে পারে—সম্প্রতি এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

গত ১০ ডিসেম্বর জাতীয় ভ্যাট দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ২০২১-২২ সালের আগে নতুন ভ্যাট আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। আর ভ্যাট হারও তিনটি হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। তবে ভ্যাট হার কটি হবে, তা এনবিআরই নির্ধারণ করবে বলে তিনি জানান।

২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর নতুন ভ্যাট আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হয়। এর আগে দুই দফা পেছানোর পর গত বছরের জুলাই মাস থেকে নতুন ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিছু ক্ষেত্রে অব্যাহতি দিয়ে সব পণ্য ও সেবায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসানো হয়।

ব্যবসায়ীরা প্রথম থেকেই এই আইনের বিরোধিতা করে আসছেন। তাই ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখে সরকার শেষ মুহূর্তে নতুন আইনটির বাস্তবায়ন আরও দুই বছর পিছিয়ে দেয়। নতুন আইনটি চালুর মাত্র দুই দিন আগে অর্থাৎ গত বছরের ২৯ জুন অর্থমন্ত্রী ভ্যাট আইন পিছিয়ে দেওয়ার এই ঘোষণা দেন।

অন্যদিকে নতুন ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নিতে ২০১৪ সালে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক নমনীয় শর্তের ৬ কোটি ডলার ঋণ দেয়। সেই প্রকল্পও চলমান আছে। এই প্রকল্পের মূল্য উদ্দেশ্য হলো, অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে করদাতাদের সহজে ভ্যাট প্রদানের সুযোগ করে দেওয়া। এর ফলে করদাতাদের মধ্যে স্বপ্রণোদিত হয়ে ভ্যাট দেওয়ার প্রবণতা যেমন বাড়বে, তেমনি ভ্যাট আদায়কারী এনবিআরের কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা কমবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।তা ছাড়া একটি সমন্বিত ভ্যাট ব্যবস্থা প্রণয়নের পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতেই এই প্রকল্প নেওয়া হয়।

Share