নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ‘কোনো কিছু বললে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমরা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমাদের এখান থেকে উদ্ধার করেন। আমাদের বাঁচান। তা না হলে আমাদের এখানে আত্মহত্যা করা লাগতে পারে। আমরা খুবই করুণ অবস্থার মধ্যে আছি।’
কাজের সন্ধানে মালয়েশিয়া গিয়ে তিন মাস ধরে একরকম বন্দী জীবন যাপন করা অর্ধশতাধিক তরুণ–যুবক এমন আকুতি জানিয়েছেন। তাঁদের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কয়েকটি গ্রামে। আকুতি জানানোর এমন পাঁচটি ভিডিও ক্লিপ পাওয়া গেছে।
রোববার সকালেও তাঁদের সঙ্গে হোয়াটসআপে যোগাযোগ করা হয়। ‘বন্দী’ তরুণ–যুবকেরা জানান, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে তিনতলা একটি ভবনে নিচতলা ও দোতলায় অন্তত ৬৩ জন রয়েছেন। তাঁদের সবার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক মাসের মধ্যে কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও তিন মাস পেরিয়ে গেছে; তাঁরা কোনো কাজ পাননি। এমনকি ঘর থেকে তাঁদের বেরও হতে দেওয়া হয় না। দুবেলা শুধু আলুভর্তা ও ডাল খেয়ে থাকছেন।
হোয়াটসআপে ভিডিও কলে কথা বলে জানা গেল, গত বছরের নভেম্বরে মেহেরপুর গাংনি উপজেলার কাজিপুর ইউনিয়নের চারটি গ্রাম ও মটমুড়া ইউনিয়নের মহাম্মদপুর গ্রামের অন্তত ৬৩ জন তরুণ ও যুবক শ্রমিকের কাজের জন্য মালয়েশিয়া যান। সাহেবনগর গ্রামের সুরুজ আলী, আওয়াল এবং মহাম্মদপুর গ্রামের আবদুল্লাহ তাঁদের শ্রমিকের কাজ দেওয়ার কথা বলে সে দেশে নিয়ে যান। সুরুজ, আওয়াল ও আবদুল্লাহ একে অপরের মামাতো–ফুফুতো ভাই। প্রত্যেকের কাছ থেকে চার–পাঁচ লাখ করে টাকা নেন তাঁরা। কথা ছিল মালয়েশিয়া পৌঁছানোর ৪০ দিনের মধ্যে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে নির্মাণকাজে শ্রমিকের কাজ দেওয়া হবে।
কাজিপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড ইউপির সদস্য ফারুক হোসেন বলেন, কাজিপুর ও আশপাশের এলাকা থেকে শতাধিক মানুষ গেছে ভালো কাজের আশায়। তাঁদের ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সি মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করে। তাঁরা কেউই কাজ পাননি।
ভুক্তভোগী তরুণদের অভিযোগ, গত বছর ৬ নভেম্বর ৫৪ তরুণকে ঢাকার বনানীতে ৪ নম্বর সড়কে অবস্থিত একটি এজেন্সির কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁরা কয়েকদিন থাকার পর ১১ নভেম্বর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঢাকা বিমানবন্দরে একটি ফ্লাইটে ৫৪ জনকে মালয়েশিয়াতে নিয়ে যান। সেখানে নামার পর এজেন্সির লোকজন তাঁদের গাড়িতে করে একটি ভবনে নিয়ে তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নেন। এরপর চলতে থাকে তাঁদের বন্দিজীবন।
বন্দী তরুণেরা বলছেন, গাদাগাদি করে তাঁরা কয়েকটি কক্ষে থাকেন। তাঁদের প্রায় সবার ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারেন না। সকাল ও রাতে দুই বেলা তাঁদের আলু, ডাল ও চাল দিয়ে যায়। তাঁরা ঘরের ভেতরে আলুভর্তা, ডাল ও ভাত রান্না করে খান। সেটাও অপ্রতুল। নিদারুণ কষ্টে তাঁরা জীবন কাটাচ্ছেন।
যাঁরা খাবার দিয়ে যান, তাঁরা চীনা ও মালয়েশিয়ার নাগরিক। কোনো কথা বলেন না। কাজের কথা বললে ভয় দেখান। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা পাঠিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলেন। বন্দি থাকতে থাকতে অনেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে সাহেবনগর গ্রামের বাসিন্দা ও মূল দালাল সুরুজ আলীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সুরুজ ও আওয়ালের নিকটাত্মীয় মহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল্লাহ। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে আবদুল্লাহ বলেন, ‘মালয়েশিয়াতে কিছু ঝামেলা হয়েছে। এ জন্য কাজ দিতে পারছি না। চলতি মাসের মধ্যেই সবার কাজ দেওয়া হবে। যাঁরা কাজ পাবেন না, তাঁদের ভিসা লাগিয়ে দেশে ফেরত আনা হবে। আশা করা যাচ্ছে, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সবার কাজ হয়ে যাবে।’
দেশে ফেরত আসার পর তরুণেরা টাকা ফেরত পাবেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তর দেননি আবদুল্লাহ। তিনি আরও বলেন, ঢাকার ওই ট্রাভেল এজেন্সির তিনি কম্পিউটার অপারেটর। এ জন্য এলাকার কিছু যুবকের কর্মসংস্থানের জন্য নিয়ে গেছেন।
রোববার কাজিপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় মালয়েশিয়া যাওয়া রুবেল নামের এক যুবকের স্ত্রী শিল্পী খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী বিদেশে যাওয়ার পর থেইকি কষ্টে আছে। তিনবেলা খাইতে পারে না। বাড়ি আশার জন্য প্রতিদিন কান্দে। আমাদের আর কিছু বাকিনি যা বেইছি তাকে দেশে আনবু।’
একই এলাকার রাশিদুলের স্ত্রী সাথী খাতুন বলেন, ‘বসতবাড়ির এক শতক জমি বিক্রি ও চড়া সুদে তিন লাখ টাকা লোন (ঋণ) নি বিদেশ গিচে। সেকানে গি আমার স্বামী খুব কষ্টে আছে। কুনু কাজ কাম পাইনি। এখন বাড়িতি ফিরবি কি কইরি তারও ঠিকনি।’
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. শামীম হাসান বলেন, রোববার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের পরিবারকে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কেউ মামলা করতে রাজি হচ্ছেন না।