নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এক কিশোর অপহৃত হওয়ার পর তাঁর মা–বাবা পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তবে সেখান থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে অপহরণকারীর চাহিদামতো মুক্তিপণের ৩০ লাখ টাকাও জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু সেই ছেলেকে আর ফিরে পাননি তাঁরা। তিন দিন পর বসুন্ধরা এলাকা থেকেই উদ্ধার করা হয় তাঁর গলাকাটা লাশ।
নিহত তৌহিদুল ইসলাম (১৯) পরিবারের সঙ্গে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর সড়কের ডি ব্লকে থাকতেন। তাঁর বাবা মোহাম্মদ নবী হোসেন জমি কেনাবেচার ব্যবসায় যুক্ত। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তৌহিদুল ছিলেন দ্বিতীয়। আগে মাদ্রাসায় পড়ে আসা তৌহিদুল বর্তমানে ভাটারার ডুমনি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তেন।
এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে জুয়েল রানা (২৮) নামে বসুন্ধরা সিকিউরিটিজের একজন নিরাপত্তাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ২৬ নভেম্বর সকালে বসুন্ধরার ‘প’ ব্লকের একটি ছনক্ষেত থেকে তৌহিদুলের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তৌহিদুলকে হত্যার দায় স্বীকার করে জুয়েল রানা ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলেও পুলিশ জানিয়েছে।
তবে এ মামলায় থানা পুলিশের তদন্তে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না তৌহিদুলের বাবা মোহাম্মদ নবী হোসেন। তিনি বলেন, জুয়েল রানার একার পক্ষে তৌহিদুলকে খুন করা সম্ভব নয়। এ হত্যায় একটি চক্র জড়িত। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তিনি এর তদন্তভার ভাটারা থানা থেকে ডিবিকে (গোয়েন্দা পুলিশ) দেওয়ার জন্য ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের কাছে আবেদন করেছেন।
মুক্তিপণ নিতে যা করেন ঘাতক : তৌহিদুলের বাবা নবী হোসেন প্রথম আলোকে জানান, গত ২৩ নভেম্বর রাতে কে বা কারা তৌহিদুলকে ডেকে নিয়ে যান। রাত ১০টার পর তৌহিদুলের মুঠোফোন থেকে তাঁর মাকে ফোন করা হয়। বলা হয়, তৌহিদুলকে অপহরণ করা হয়েছে। তাঁকে ফিরে পেতে হলে দুই ঘণ্টার মধ্যে ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। এত রাতে এত টাকা তাঁর কাছে নেই জানিয়ে সময় চাইলে অপহরণকারী তা মানছিলেন না। তারপরেও তৌহিদুলের মুক্তির জন্য অপহরণকারীর সঙ্গে রফা চলতে থাকে। এর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ভাটারা থানায় যান তাঁরা। থানা পুলিশ লিখিত অভিযোগ নিলেও তা মামলা হিসেবে আমলে নেয়নি।
নবী হোসেন বলেন, ভাটারা থানা পুলিশের কাছ থেকে যথেষ্ট সাড়া না পেয়ে ছেলের মুক্তির জন্য তিনি টাকা জোগাড় করেন। অপহরণকারী পরদিন সকাল সাতটার দিকে টাকা নিয়ে মিরপুর মাজার রোডে থাকতে বলেন। সে কথামতো তাঁরা মিরপুরে গেলে অপহরণকারী আগের রাতের দেওয়া স্থান পরিবর্তন করে মিরপুর ১০ নম্বরে টাকা রেখে যেতে বলেন। তখন অপহরণকারীকে তৌহিদুলের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু অপহরণকারী তৌহিদুলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে রাজি হননি; বরং তিনি বলেন, তৌহিদুল ভালো আছেন। তাঁর শরীর কিছুটা দুর্বল। অপহরণকারী ভয় দেখিয়ে তৌহিদুলের বাবাকে এ–ও বলেন, আরও তিনজনকে অপহরণ করা হয়েছিল; কিন্তু তাঁদের মা–বাবা টাকা দিয়ে তাঁদের সন্তানদের ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। এরপর অপহরণকারী ফোন বন্ধ করে দেন। পরে অপহরণকারীকে টাকা না দিয়ে তাঁরা বাসায় ফিরে যান। পরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আবার অপহরণকারীর ফোন থেকে মুক্তিপণ চাওয়া হয়।
নবী হোসেন বলেন, ২৪ নভেম্বর অপহরণকারীর কথাবার্তায় সন্দেহ হলে রাতে তাঁরা ভাটারা থানায় যান এবং তখন একটি ‘মাধ্যমের তদবির’ করলে ভাটারা থানা অপহরণের মামলা নেয়। পরে ওই রাতে তৌহিদুলের বাবা পুলিশকে একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে দিলে তারা দিনাজপুরের কাহারোলে অভিযান চালিয়ে অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করে। তখন অপহরণকারী জুয়েল রানার নাম তাঁরা জানতে পারেন।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের পর অপহরণকারী অনবরত পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে থাকে। অবশেষে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে জুয়েল রানার তথ্যের ভিত্তিতে বসুন্ধরার প ব্লকের ছনখেত থেকে তৌহিদুলের গলাকাটা লাশ এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রক্তমাখা ছুরি উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার জুয়েল রানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি এখন কারাগারে।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি : পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, জুয়েল রানা গত ৩০ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে তৌহিদুল হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, স্নাতক পাস করে চার বছর ধরে বসু্ন্ধরা সিকিউরিটিজের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করছেন। বসুন্ধরা এলাকার বাসিন্দা হিসেবে তৌহিদুলের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। তৌহিদুলকে তিনি ‘মামা’ বলে ডাকতেন। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে একটি জমি কিনবেন বলে এর দাম সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ঠিক হয়েছিল। কিন্তু তাঁর কাছে এত টাকা ছিল না। তিনি বসুন্ধরা থেকে মাসে মাত্র ১৪ হাজার ৩০০ টাকা বেতন পান। অভাব থেকে খুন করার মতো খারাপ চিন্তা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তৌহিদুলকে হত্যা করে মুক্তিপণের টাকা নেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী জুয়েল রানা গত ২২ নভেম্বর তৌহিদুলকে বসুন্ধরার পি ব্লকে নিয়ে যান হত্যা করার জন্য। কিন্তু সেদিন তাঁকে হত্যা করতে পারেননি। পরদিন বিকেলে বসুন্ধরার প্রধান ফটকের একটি সুপারশপ থেকে ৮৫ টাকা দিয়ে একটি ছুরি কেনেন। এরপর তিনি তৌহিদুলকে হত্যা করতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন। ২৩ নভেম্বর রাত আটটার পরে তৌহিদকে মদ খাওয়ার কথা বলে বসুন্ধরার প ব্লকে ডেকে নিয়ে যান। প্রথমে তৌহিদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন। একপর্যায়ে ছোরা দিয়ে তাঁকে এলোপাতাড়ি কোপান। তখন তৌহিদুল শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে তৌহিদুলের গলায় চাকু দিয়ে আঘাত করলে তিনি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এরপর তৌহিদুলের মুঠোফোনটি নিয়ে নেন জুয়েল রানা। চাবি খুঁজে না পাওয়ায় তৌহিদুলের মোটরসাইকেলটি নিতে পারেননি। পরে বসুন্ধরা সিকিউরিটিজের ব্যারাকে ফিরে শ্বশুর মারা যাওয়ার কথা বলে ছুটি নেন জুয়েল রানা।
জুয়েল রানা জবানবন্দিতে বলেন, ২৩ নভেম্বর রাতে তৌহিদুলের মুঠোফোন থেকে তার মায়ের কাছে ফোন করে ছেলেকে অপহরণের কথা জানিয়ে অনেকবার মুক্তিপণ চান। পরদিন সকাল আটটা পর্যন্ত তৌহিদুলের পরিবার থেকে মুক্তিপণের কোনো নিশ্চয়তা পাননি জুয়েল রানা। তখন তিনি সন্দেহ করেন, হয়তো তৌহিদুলের পরিবার তাঁকে ধরার চেষ্টা করছেন। ২৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে আটটার দিকে হানিফ পরিবহনে জুয়েল রানা গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের কাহারোলে চলে যান।
তদন্তভার ডিবির কাছে দেওয়ার দাবি : মামলার বাদী ও তৌহিদুলের বাবা নবী হোসেন গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তরে গিয়ে যুগ্ম কমিশনার লিটন কুমার সাহার সঙ্গে দেখা করে তাঁর ছেলে হত্যার ন্যায়বিচার চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তিনি বলেন, কারও একার পক্ষের খোলা মাঠে তৌহিদুলকে খুন করা সম্ভব নয়। তাঁর ছেলে অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত হলে তা বেরিয়ে আসবে। এ জন্য তিনি ডিএমপি কমিশনারের কাছে মামলার তদন্তভার ডিবিতে দেওয়ার আবেদন করেছেন।