নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : চীন থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ালেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে নিউ ইয়র্ক রাজ্যে। এখন বর্তমানে নিউ ইয়র্কে বসন্ত চললেও পরিস্থিতির ভয়াবহতায় সেখানে চলছে মানুষের আহাজারি, বাজছে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনে আওয়াজ। ২০০১ সালের ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলায় এই শহর যে পরিমাণ মানুষকে হারিয়েছে তার কমপক্ষে চারগুন মানুষ মারা গেছেন এরই মধ্যে। করোনা শুধু যে মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নয় এটি ধ্বংস করছে হাজার হাজার পরিবারের স্বপ্ন। তেমনি একজন বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা ট্যাক্সি ড্রাইভার মোহাম্মদ জাফরের গল্প।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন বাংলাদেশী নাগরিক মোহাম্মদ জাফর। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরই মোহাম্মদ জাফর কখনো ট্যাক্সি চালিয়েছেন , আবার কখনো রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন। এভাবেই নিজের এবং বাংলাদেশে তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করেছেন তিনি। মাঝে একবার বাংলাদেশে ফিরে এসে মাহমুদা খাতুন নামের এক নারীকে বিয়েন মোহাম্মদ জাফর । বাংলাদেশেই তাদের প্রথম সন্তান মাহবুব রবিনের জন্ম হয়। পরে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যায় মোহাম্মদ জাফর।
নিউ ইয়র্কে ২০০০ সালে এলমহার্স্ট হাসপাতালে জন্ম হয় মোহাম্মদ জাফরের দ্বিতীয় সন্তান মাহতাব সিহাবের। এখন করোনা ভাইরাসের গ্রাউন্ড জিরো হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই হাসপাতাল। পরে তার আরেক কন্যা সন্তানেরও জন্ম হয় যুক্তরাষ্ট্রেই। কম আয় করতে পারলেও সন্তানদের লেখা পড়ার বিষয়ে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন মোহাম্মদ জাফর। একটি বিশেষ সুযোগের আওতায় নিজের দ্বিতীয় সন্তান মাহতাবকে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ট্রিনিটির মতো ব্যয়বহুল স্কুলে ভর্তি করান মোহাম্মদ জাফর। ২০১৬ সালে জাফর তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুনকে হারান। এইসময়ে জাফরের পুরো পরিবারটি দিশেহারা হয়ে পড়ে। ক্যান্সারের আক্রান্ত হয়ে মারা যান মাহমুদা খাতুন। কিন্তু এরপরেই মোহাম্মদ জাফরের স্বপ্ন আবারো জোড়া লাগতে শুরু করে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে জাফরের ছেলে মাহতাব যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পান। হার্ভার্ডে অর্থনীতি ও ইতিহাসের মতো ডাবল সাবজেক্টে পড়াশোনা করছেন তিনি। পাশপাশি জাফর তার ছোট মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দেন ট্রিনিটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে।
ছেলে হার্ভার্ডে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় খুব উচ্ছসিত ছিলেন জাফর। সামনের দিনগুলোতে খুব ভালোভাবে জীবন কাটাতে পারবেন সেই স্বপ্ন তার ছিল বলে জানিয়েছেন জাফরের ছেলে মাহতাব। তবে এই বছরের মার্চ মাসে জাফরের স্বপ্নে পুরোপুরি শেষ পেরেক ঠুকে দেয় করোনা ভাইরাস।
করোনায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পর বাড়িতে ফিরে মাহতাব দেখেন তার বাবা মোহাম্মদ জাফর বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে আছেন। জীবিকা নির্বাহের করোনা আতঙ্কের মধ্যে মাঝে মাঝে তিনি ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেন। পরে একদিন হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন জাফর। শুরু হয় শ্বাস কষ্ট। এমন অবস্থায় মোজাফফরকে নিউ ইয়র্কের মন্টিফিওর মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে ভালোই উন্নতি হচ্ছিল জাফরের। কিন্তু হঠাৎ হাসপাতালে করোনার সঙ্গে যুদ্ধে হেরে মারা যান জাফর। আর এতেই শেষ হয়ে যায় জাফরের ভালো জীবন যাপনের স্বপ্ন। মারা যাওয়ার সময় ৫৬ বছর বয়স হয়েছিল জাফরের।
বাবার মৃত্যুতে বেশ ভেঙ্গে পড়েছেন পুত্র মাহতাব। বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাহতাব বলেন, সে পুরো জীবন কষ্ট করে গেছেন। কাজ না পেয়ে সে কখনো ম্যাকডোনাল্ড’সে কাজ করেছেন। ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজও করেছেন আমার বাবা। তবে সে তার কঠোর পরিশ্রমের ফল পায়নি। আমার বাবা এমন সময় মারা গেলেন যখন আমি আর আমার ভাই আমাদের ক্যারিয়ার গড়ছি।
জাফরের মৃত্যুর খবর পেয়ে মাহতাবের বন্ধুমহল দ্রুত ছুটে এসে দাঁড়ান তাদের পরিবারটির পাশে। মাহতাবের বন্ধু উইল ক্রামার ‘গো ফান্ড মি’ প্রচারণায় সহায়তা করলেন। তাতে সব সম্প্রদায়ের মানুষ কম-বেশী যে যা পারেন জমা দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ ডলারের অনুদান বিভিন্ন জায়গায় থেকে সংগ্রহ করে দিয়েছে ওই প্রচারণা। এ বিষয়ে মাহতাবের বন্ধুরা বলেন, মোহাম্মদ জাফরের সন্তানদের বাবা মা ফিরিয়ে দিতে পারবো না। তারা এতিম হতে পারে কিন্তু একা না।
শুধু জাফর নয়। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে আসা অনেকের স্বপ্নই হয়তো কেড়ে নিচ্ছে করোনা ভাইরাস। এই মহামারি ঠিক হলে হয়তো আবার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা চালু হবে। আবারো কর্মযজ্ঞ হয়ে পড়বে নিউ ইয়র্ক। জাফরের মতো মানুষরাও আবার কাজে যোগ দেবেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা এটি নিশ্চিত না কেউ। সিএনএন।