নয়াবার্তা প্রতিবেদক : বাবা অটোরিকশাচালক, মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। বাবা-মায়ের টানাপোড়েনের সংসারে অর্থকষ্টে জর্জরিত থাকা অবস্থায় তাদের ১৭ বছর বয়সী মেয়েটি দুবাই যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
দুচোখ ছাপানো স্বপ্ন নিয়ে দুবাই পাড়ি জমান। কথা ছিল তাকে দেওয়া হবে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ। কিন্তু চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে যৌনকর্মী হিসেবে দুবাইয়ে পাচার করা হয়। কিছুদিন পর সেখানে নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করা হয়।
১৭ বছর বয়সী অসহায় কিশোরীকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে যৌনকর্মী হিসেবে দুবাইতে পাচার ও নির্যাতনে হত্যার ঘটনার প্রধান দুই আসামি ফারজানা (৩৫) এবং সোহাগী ওরফে রিয়াকে (৩০) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩।
রোববার (২৪ মার্চ) র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা ভুক্তভোগীকে দুবাইপ্রবাসী ফারজানা ও তার বোন সোহাগী মিলে দুবাইতে যৌনকর্মী হিসেবে পাচার করে দেয়।
সেখানে অবস্থানকালীন ৮ সেপ্টেম্বর মেয়েটির মৃত্যু হয়। দুবাইতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে দুবাইপ্রবাসী একজন বাঙালি মেয়েটির মরদেহ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গত বছরের ২৪ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে পোস্ট করেন।
ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার দুদিন পর ২৬ নভেম্বর মেয়েটির পরিবার জানতে পারে, দুবাইয়ে মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। পরে মরদেহ দেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয় এবং মেয়েটির বাবা জাহাঙ্গীর বাদী হয়ে ২৮ নভেম্বর মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন ট্রাইব্যুনালে মানবপাচার ও হত্যার অভিযোগে একটি নালিশি মামলা করেন।
এ মামলায় ফারজানা ও সোহাগীসহ অজ্ঞাতনামা আরও দু-তিনজনকে আসামি করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে নালিশি অভিযোগটি যাত্রাবাড়ী থানায় এজাহার হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়। র্যাব এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
গ্রেফতাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, মেয়েটি দীর্ঘদিন ধরে তার পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এলাকায় আসামিদের পাশাপাশি বাড়িতে বসবাস করে আসছিল।
টানাপোড়েনের সংসারে হাল ধরতে চেয়েছিলেন মেয়েটি :
র্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, মেয়েটির বাবা জাহাঙ্গীর সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে এবং তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতো।
তিনি বলেন, এভাবে টানাপোড়েনের সংসারে অর্থকষ্টে জর্জরিত থাকা অবস্থায় মেয়েটিকে তাদের প্রতিবেশী সোহাগী ও তার দুবাই প্রবাসী বোন ফারজানা দুবাই নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রলোভন দেখাতে শুরু করে। দুবাই প্রবাসী ফারজানা মেয়েটিকে জানায়, তাকে দুবাই নিয়ে একটি হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ পাইয়ে দেবে। যার মাধ্যমে অনেক ভালো বেতন এবং ভাতাসহ অন্যান্য অনেক সুবিধা পাবে এবং তার পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসবে।
বিজ্ঞাপন
তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দুবাই :
দুবাই নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার খরচের কথা বলে ফারজানা ও সোহাগী মেয়েটির পরিবারকে তিন লাখ টাকা জোগাড় করে দিতে বলে। বিষয়টি নিয়ে মেয়েটি পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে এবং ঋণ করে তিন লাখ টাকা জোগাড় করে সোহাগীর হাতে তুলে দেয়।
ভুয়া ঠিকানায় পাসপোর্ট ও ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই :
ফারজানার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী, সোহাগী তাদের চক্রের দালালের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের একটি ভুয়া ঠিকানা সংবলিত পাসপোর্ট ও ট্যুরিস্ট ভিসা প্রস্তুত করে।
যেভাবে যৌনকর্মী হিসেবে দুবাইয়ে পাচারের পর বিক্রি :
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত বছরের ১৬ আগস্ট মেয়েটিকে তারা দুবাই পাঠিয়ে দেন। দুবাই পৌঁছানোর দুইদিন পর মেয়েটি তার বাবা জাহাঙ্গীরকে মোবাইলে জানান, আসামিরা দুবাইতে উচ্চ বেতনের চাকরির মিথ্যা প্রলোভন ও আশ্বাস দিয়ে তাকে যৌনকর্মী হিসেবে পাচারের পর বিক্রি করে দিয়েছে।
মেয়েটি বাবাকে আরও জানান, সেখানে তাকে অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। একপর্যায়ে নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ৮ সেপ্টেম্বর মেয়েটি মারা যান। এরপর নিহতের সঙ্গে তার পরিবারের আর কোনো যোগাযোগ করতে না পারায় তারা গ্রেফতার সোহাগীর দ্বারস্থ হয়।
মেয়েটির পরিবারকে হুমকি-ধামকি দিতে থাকে আসামিরা :
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক আরও বলেন, সোহাগী ও ফারজানা মিলে মেয়েটির পরিবারকে বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিতে থাকে এবং তাদের জানায়, তাদের মেয়ে দুবাইতে খুব ভালো আছে, সময় পেলেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
যেভাবে মেয়ের মরদেহ শনাক্ত করে পরিবার :
গত ২৪ নভেম্বর দুবাই প্রবাসী এক বাংলাদেশি যুবক দুবাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে মেয়েটির মরদেহ দেখতে পায় এবং তার পরিবারের কাছে মরদেহটি হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে পাসপোর্টের তথ্য ও ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করে।
বিষয়টি ২৬ নভেম্বর মেয়েটির পরিবার জানতে পারে এবং মরদেহ দেশে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েটির বাবা জাহাঙ্গীর বাদী হয়ে মানবপাচার দমন ও প্রতিরোধ আদালতের মাধ্যমে মামলা দায়ের করেন।
গ্রেফতাররাও দুবাই গিয়ে দেশে ফেরত আসে :
গ্রেফতার ফারজানা ২০২৩ সালের মার্চ মাসে দুবাই গিয়েছিল এবং মেয়েটি মারা যাওয়ার পর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সে দেশে ফিরে আসে। দেশে ফিরেই তার বোন সোহাগীকে নিয়ে আত্মগোপনে চলে যায় ফারজানা। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় র্যাব-৩ এর একটি চৌকস আভিযানিক দলের হাতে তারা গ্রেফতার হয়।
