নয়াবার্তা প্রতিবেদক : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। শুল্ক-কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি যখন কমে গেছে, তখন আইএমএফের শর্ত মেনে আগামী অর্থবছরে নিয়মিত শুল্ক-কর আদায়ের অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো সংগ্রহ করতে হবে। কমাতে হবে কর ছাড়। তাই এনবিআর এখন কর আদায় বাড়াতে নতুন নতুন উপায় খুঁজছেন শুল্ক-কর কর্মকর্তারা।
আইএমএফের যেসব শর্ত পূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এনবিআরকে, সেসব শর্ত এসেছে গত জানুয়ারির শেষের দিকে বাংলাদেশের জন্য অনুমোদন করা ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অংশ হিসাবে। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি এনবিআরের জন্য সময় ধরে শর্ত দেওয়া হয়েছে। এসব শর্তের একটি আগামী অর্থবছরে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। অতিরিক্ত শুল্ক-কর হতে হবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫০ শতাংশ।
এ ছাড়া শুল্ক-কর ছাড় যৌক্তিক করার উদ্যোগ নিতেও শর্ত দেওয়া হয়েছে। এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, আইএমএফের শর্ত মেনে আগামী অর্থবছরে বাড়তি ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে। এ জন্য আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যা এ বছরের লক্ষ্য থেকে ১৬ শতাংশ বেশি। কিন্তু চলতি বছরে রাজস্ব আদায়ে যদি ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়, তাহলে আগামী অর্থবছরের লক্ষ্য অর্জনে এখনকার তুলনায় ২৫ শতাংশের বেশি শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। এত প্রবৃদ্ধি আগে কখনোই হয়নি।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বর্তমান কর প্রশাসন দিয়ে আগামী অর্থবছরে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা অসম্ভব হবে। সংস্কার যদি আরও তিন-চার বছর আগে শুরু হতো, তাহলে সম্ভব হবে। এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে আমদানি শুল্ক বাড়বে না। আবার মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। তাই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও শুল্ক-কর বাড়ানো কঠিন হবে।’
এ ক্ষেত্রে আহসান এইচ মনসুর দুটি পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যৌক্তিকভাবে কর ছাড় কমানো হলে বছরে ১০-১৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আসতে পারে। কিন্তু সেখানে সমস্যা হলো কোনো খাতের সুবিধা উঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেই ওই খাতের প্রভাবশালীরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তদবির শুরু করবেন। এ ছাড়া ভর্তুকি কমালেও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে চাপ কমবে।
এনবিআর যা করছে : বাজেট তৈরির কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আবার শুল্কছাড় যৌক্তিক করা এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে এনবিআর ও আইএমএফ-উভয় পক্ষের একটি দল যৌথভাবে কাজ করছে। এনবিআরের আয়কর বিভাগের সদস্য শামসউদ্দীন আহমেদ এনবিআরের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এতে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছেন। বিষয়টি নিয়ে এই দলটি ইতিমধ্যে একাধিকবার বৈঠক করেছে।
কোন কোন খাত থেকে এবং কীভাবে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা যায়, ওই দলটি এর কৌশল ঠিক করছে। কোন খাতে কত কর ছাড় আছে, কোনটি বাদ দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। জানা গেছে, বড় শহরের বাড়িওয়ালা, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্য, গাড়ির মালিক, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগকারীদের ওপর নজর বাড়িয়ে বাড়তি লক্ষ্য অর্জন করতে চায় এনবিআর। এ জন্য সিটি করপোরেশন এবং বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
পাশাপাশি প্রাপ্ত তথ্য আয়কর বিভাগের টিআইএন সার্ভারের সঙ্গে মিলিয়ে নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। অন্যদিকে আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের মতো পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যবসায়ী সংগঠনের কাছ থেকে তাদের সদস্যদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাঁরা সঠিকভাবে কর দেন কি না, তা আরও নজরদারিতে রাখার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, এসব কৌশল নিয়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এনবিআরের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, আইএমএফ এই ধরনের উদ্যোগের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বেশি চায়। এনবিআর সূত্রে আরও জানা গেছে, অতিরিক্ত ১৫টি কর অঞ্চল করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আইএমএফের সঙ্গে এনবিআর রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং কর ছাড় কমানোর কৌশল নিয়ে কাজ করছে। বছরের পর বছর শত শত ক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এগুলো এখন খুঁজে বের করা হচ্ছে।’
এত রাজস্ব আসবে কীভাবে : আইএমএফের শর্ত মেনে এনবিআরের আগামী অর্থবছরের ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। কিন্তু এনবিআর রাজস্ব আদায়ের গতিপ্রকৃতি ভিন্ন রকম ইঙ্গিত দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই শুল্ক-কর আদায়ের গতি কমেছে। যত সময় যাচ্ছে, ততই রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি কমছে। বাস্তবে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে নেমে গেছে।
অর্থ বছরের শুরুতে গত জুলাই মাসে শুল্ক-কর আদায় হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। পরের মাসে ২১ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রবৃদ্ধির ধারা ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ তা কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। আট মাস ধরে মাসিক রাজস্ব আদায় ১৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।
চলতি অর্থবছরে ২৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে বলা হয়েছিল এনবিআরকে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ বছর ১০-১২ শতাংশের মধ্যেই প্রবৃদ্ধি থাকবে। সেই হিসাবে রাজস্ব আদায়ে বছর শেষে ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো ঘাটতি হতে পারে।
এদিকে গত পাঁচ অর্থবছরে বছরব্যাপী রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক নয়। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল এনবিআর। এরপর রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ১০ থেকে ১৬ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কোভিডের শুরুর বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল নেতিবাচক। তাই আগামী অর্থবছরে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করব, এসব বলে আইএমএফকে বোঝানো যাবে না। আইএমএফ চায়, প্রশাসনিক সংস্কার। কর প্রদান প্রক্রিয়ায় অটোমেশন চায়। যেখানে করদাতা ও কর কর্মকর্তারা কেউ কারও মুখ দেখবে না।’