নিজস্ব জেলা প্রতিবেদক : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণার পর থেকেই কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে এনজিওকর্মীদের আনাগোনায় সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন অনেকে। বিশ্নেষকরা তখনই সতর্ক করেছিলেন যে, এনজিওর কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জটিল হচ্ছে। ২২ আগস্টের আগের দু’দিন গণমাধ্যমকর্মীদের সংবাদ সংগ্রহেও বাধা দিয়েছে কিছু এনজিওকর্মী। এ ঘটনায় সুবিধাভোগী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে কাজ করছে বলে সমকালে সরেজমিন সংবাদ প্রকাশ হয়।
অবশেষে সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। দেশি-বিদেশি কয়েকটি এনজিও প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্ররোচিত করে। প্রত্যাবাসন শুরুর প্রাক্কালে ওই বিবৃতি ছিল আগুনে বাতাস দেওয়ার মতোই।
রোহিঙ্গাদের কারণে তীব্র চাপে থাকা স্থানীয়দের সব অভিযোগের তীর এখন ওই এনজিওগুলোর দিকে। প্রত্যাবাসন না হওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা। তাদের দাবি, প্রত্যাবাসন না হওয়ার জন্য দায়ী এনজিও সংস্থাগুলো। রোহিঙ্গাদের পুঁজি করে তারা ব্যবসা করছে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে প্রত্যাবাসন আরও কঠিন হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে কারা তৎপর, কারা প্ল্যাকার্ড, লিফলেট সরবরাহ করছে, কারা ইংরেজিতে পোস্টার লিখে তাদের হাতে পৌঁছাচ্ছে এসবের বিরুদ্ধে জোরালো তদন্ত করে তা উদ্ঘাটন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের এদেশে থাকার প্ররোচনা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত কিছু দেশি-বিদেশি এনজিওর তালিকা করে তাদের নজরদারির আওতায় আনা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের পূর্বশর্ত হিসেবে যেসব দাবি জানাচ্ছে, তা তাদের নিজস্ব সৃষ্টি নয়। এসবের নেপথ্যে রয়েছে কিছু এনজিও। রোহিঙ্গারা এদেশে যত বেশি সময় থাকবে, তাদের ততই লাভ বলে মনে করা হচ্ছে।
দেশি-বিদেশি অর্থায়নে শতাধিক এনজিও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের নামে গড়ে তোলা সংগঠনগুলো বিদেশ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে থাকে। এ ধরনের ৬০টিরও বেশি এনজিও গত বুধবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে তৎপরতা দেখিয়েছে।
তবে ক্যাম্পগুলোতে প্রত্যাবাসনবিরোধী কাজে কিছু বিদেশি সংস্থার ইন্ধনের পরও সরকারি কর্মকর্তাদের চুপ থাকতে দেখা গেছে। নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক এক কর্মকর্তা বলেন, এনজিওগুলোর কাছে তারা অসহায়। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসন বা ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাকারী সংগঠনগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) নামের একটি প্রেশার গ্রুপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের নানা বিষয়ে সংযোগ রক্ষার জন্য একজন এনজিওকর্মীকে আইএসসিজির সমন্বয়কারী করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ওই এনজিওকর্মী রোহিঙ্গা সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর রীতিমতো ‘খবরদারি’ চালিয়ে আসছেন। এসব কারণে সরকারি কর্মকর্তারা প্রত্যাবাসনের পক্ষে তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
কক্সবাজারে কর্মরত প্রায় অর্ধশত স্থানীয় এনজিও এবং সুশীল সমাজের নেটওয়ার্ক ‘কক্সবাজার সিএসও-এনজিও ফোরাম’ (সিসিএনএফ) এক গবেষণায় জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোট ১২৩টি দেশি-বিদেশি এনজিও কাজ করছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক এনজিও রয়েছে ২১টি এবং কক্সবাজারের স্থানীয় এনজিও রয়েছে পাঁচটি। অন্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে কাজ করছে। এসব এনজিও বিভিন্নভাবে অর্থ এনে রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয়ের কথা বললেও এসব অর্থের একটি অংশ ব্যয় করা হচ্ছে কর্মকর্তাদের পেছনে। কর্মকর্তাদের দামি গাড়ি, উচ্চ বেতনে চাকরি ও ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা-খাওয়াসহ বিলাসী জীবনযাপনে এসব অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। কক্সবাজার শহর, টেকনাফ ও উখিয়ায় এখন পর্যটন মৌসুম না থাকলেও হোটেলে জায়গা পাওয়া কঠিন। দামি হোটেলগুলো এনজিও কর্মকর্তারা নিয়ে নিয়েছেন। মাসের পর মাস তারা পুরো হোটেল ব্যবহার করেন।
জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) অনুযায়ী, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট মেটাতে ৪৩ কোটি ডলার প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে ৩১ কোটি ডলার জেআরপির মাধ্যমে পাওয়া যায়. যা ছিল সে বছর প্রাপ্ত মোট তহবিলের প্রায় ৩৬ শতাংশ। ২০১৮ সালে জেআরপি অনুসারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ৯৫ কোটি ডলারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। সে বছর পাওয়া যায় ৬৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে এই পরিকল্পনার বাইর থেকে এসেছে মোট ৭ কোটি ডলার। চলতি বছর জেআরপির আওতায় ৯২ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি পরিবারের জন্য এক বছরে ২১৫ ডলার (১৮ হাজার টাকার বেশি) ব্যয় করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ইউএনএইচসিআরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে এসে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় সাহায্যের পরিমাণ খুব সীমিত বা অপর্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। বছরের প্রথম সাত মাসে চাহিদার মাত্র ৩৪ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে।
তবে বরাদ্দ কমতে থাকলেও এনজিও কর্মকর্তাদের বিলাসী জীবন ঠিকই চলছে। ১ হাজার ৩০০ বিদেশি (জাতিসংঘের ১ হাজার ও অন্যান্য সংস্থার ৩০০) ও তাদের ৬০০ গাড়ির পেছনে খয়রাতি অর্থের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।
এনজিওদের বিষয়ে নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের মার্চে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪১টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছিল এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসব এনজিওর তৎপরতার ওপর আপত্তি দিয়ে এনজিও ব্যুরোতে চিঠি পাঠানো হয়। এ অবস্থায় এসব এনজিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যয়ের জন্য নতুন করে কোনো তহবিলের অনুমোদন পায়নি। তবে এসব এনজিও এখনও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। বরাদ্দ না পেলেও তারা অন্য এনজিওর কিছু কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
গত মার্চে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকেও এনজিওদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে সে সময় কমিটি বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বিদেশি এনজিওগুলোর বরাদ্দের চার ভাগের তিন ভাগই তাদের কর্মীদের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। ছয় মাসেই এনজিওগুলোর কর্মকর্তাদের হোটেল বিল বাবদ খরচ করা হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা এবং তাদের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়ায় আট কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হওয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি জানিয়েছে, কিছু এনজিওর তৎপরতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই এনজিওগুলোকে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছে তারা।
এনজিওগুলোর বরাদ্দের চার ভাগের তিন ভাগই বাংলাদেশে আসা তাদের কর্মীদের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে এনজিওদের সমন্বয় সংস্থা আইএসসিজি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
তবে এনজিওদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগের পরও তাদের লাগাম টেনে ধরার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাগুলো এখনও নির্বিকার। অবশ্য কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম সমকালকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর বিতর্কিত ভূমিকার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে আমরা এখনও কোনো এনজিওর তালিকা পাইনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
কক্সবাজারে এনজিওদের কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার বললেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সার্বিকভাবে এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে, তা তারা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছেন। দায়ী এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি শুধু এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধিত এনজিওগুলোর কাজ তদারকি করেন। জাতিসংঘ পরিচালিত এনজিওগুলোর তদারকির দায়িত্ব তার নয়।
রোহিঙ্গাদের জন্য আসা অর্থের বড় অংশ কর্মকর্তাদের বিলাসিতায় খরচ করার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, সংস্থাগুলোর অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশও তারা তদন্ত করেন। অভিযোগ আসার পর থেকে কঠোরভাবে মনিটর করা হচ্ছে। এ ছাড়া তুরস্কসহ ইসলামিক দেশের কয়েকটি এনজিও গোপনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিষিদ্ধ এসব এনজিওর বিরুদ্ধে উগ্রতা ছড়ানোরও অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় কিছু লোকের দ্বারা পরিচালিত এসব এনজিওর তৎপরতা বন্ধে প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযানে নামলেও থেমে নেই কর্মকাণ্ড।
এদিকে, ক্যাম্প ঘিরে শুধু এনজিও নয়, রোহিঙ্গা নেতাসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরাও গড়ে তুলেছে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। কিছু রোহিঙ্গার আর্থিক শক্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি জোরদার হয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে সখ্য। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন বড় বড় বাজার দেখা যায়। মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে পণ্য এনে এখানে বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় একটি চক্র রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে মাদক পাচারসহ নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির অন্যতম নেতা উখিয়ার নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জনের পথ বন্ধ করতে হবে। প্রত্যাবাসন করতে হলে আগে রোহিঙ্গাদের বাইরে যাওয়া বন্ধ, শিবিরে রোহিঙ্গাদের চাকরির সুযোগ এবং এনজিওর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, প্রত্যাবাসন সফল না হওয়ার অন্যতম কারণ রোহিঙ্গা-অর্থনীতি। রোহিঙ্গাদের এদেশে থাকার সঙ্গে অনেকের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। বিশেষ করে বিভিন্ন এনজিওর তহবিল, কর্মীদের বেতন নির্ভর করে রোহিঙ্গাদের থাকার ওপর। রোহিঙ্গারা চলে গেলে তাদের এসব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া স্থানীয় অনেক সুবিধাভোগী রোহিঙ্গার সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত হয়ে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। তারা কেউ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চাইছে না। মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়ার জন্য তারা রোহিঙ্গাদের প্ররোচিত করছে।