শেখ হাসিনাসহ আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড, গণহত্যার তদন্ত শুরু

বিশেষ প্রতিবেদক : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ড করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে।
সংস্থার উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মো. আতাউর রহমান এ কথা জানান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনাসহ অপর আসামিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ এর ৩(২) ও ৪(১)/৪(২) ধারায় এ অভিযোগের বিচার করা যাবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মত দিয়েছেন।
অভিযোগকারি পক্ষের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম এ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। সেই সাথে এক্ষেত্রে একজন তদন্তকাররী কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছে এবং ঘটনার সময়ের পত্রিকা সংগ্রহ করে পর্যালোচনা শুরু করেছেন।’
পদত্যাগের পর দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে একটি অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় গতকাল দায়ের করা হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদ আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবিরের পক্ষে আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় কো-অর্ডিনেটর বরাবর এ অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগ রেজিস্ট্রারভুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ এর ৮ ধারা অনুযায়ী আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করা হয়।
আবেদনে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনার তারিখ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া এ সময়ে আহত হয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন তারিখে নিহতরা এর আওতায় থাকবে। ঘটনার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশকে।
অপরাধের ধরণে বলা হয়েছে, আসামিদের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্যান্য আসামিরা দেশীয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র জনতাদের হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘঠনের অপরাধ।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং তৎকালীন সরকারের কতিপয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো.হারুন অর রশিদ ও কতিপয় অসাধু র‌্যাব কর্মকর্তা ও সদস্যসহ অজ্ঞতনামা অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা কর্মী, সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ,ছাত্রলীগ ও অঙ্গ সংগঠনসমূহ।
অভিযোগে বাদী ও অন্যান্য সাক্ষীদের পাশাপাশি গত ১৬ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ডকুমেন্টস হিসেবে দাখিল করা হয়েছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সংঘটিত অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে।
অটোরিকশাচালক শাহাবুদ্দিন হত্যা মামলা : রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক শাহাবুদ্দিনকে (৩৫) হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এই মামলার আবেদন করেন শাহাবুদ্দিনের বাবা আবুল কালাম। সিএমএম আদালত গতকাল বৃহস্পতিবার মামলাটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাদীর আইনজীবী লিটন মিয়া।
এই মামলার আগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরো দুটি হত্যা মামলা ও একটি অপহরণ মামলা হয়।আজকের মামলার অপর আসামিরা হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক,
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ ও যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।
মামলার আরজির তথ্য বলছে, ৫ আগস্ট শেরেবাংলা নগর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শাহাবুদ্দিন।
শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার একটি হত্যা মামলা হয় মোহাম্মদপুর এলাকার মুদিদোকানি আবু সায়েদ নিহত হওয়ার ঘটনায়।
গতকাল বুধবার হয় আরও দুটি মামলা। রাজধানীর কাফরুলে কলেজছাত্র ফয়জুল ইসলাম হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে গতকাল কাফরুল থানায় মামলা রেকর্ড করার আদেশ দেন আদালত। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানাকে অপহরণের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মামলা হিসেবে গ্রহণ করতে গতকাল উত্তরা পশ্চিম থানাকে নির্দেশ দেন আদালত।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি দেশ ছাড়েন। এখন তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।
হেলিকপ্টার থেকে গুলিতে নিহত জোবাইদ হোসেন ইমন হত্যা মামলা : হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার দারুননাজাত ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী জোবাইদ হোসেন ইমন নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১৬ জনের নামে আরও একটি মামলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালতে এই মামলা করেন নিহতের মামা আবু সাঈদ। আদালত মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে মামলাটি এফআইআর হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন।
মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ, অতিরিক্ত আইজিপি ড. খ মহিদ উদ্দিন, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) হারুন অর-রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।
এর আগে গত দুই দিনে আরও ৪টি মামলা হয় শেখ হাসিনাসহ তার সহকারীদের বিরুদ্ধে।
গত ১৩ আগস্ট প্রথম মামলা হয় হাসিনাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে। মুদি দোকানদার আবু সায়েদকে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়। তার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আরও ৩টি মামলা দায়ের হয় শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে দুটি হত্যা ও একটি অপহরণের অভিযোগে।

Share