সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নির্দিষ্ট করা নেই

দীর্ঘ হবে সরকারের মেয়াদ

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ২১দিনের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন থাকবে, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। সরকারের মেয়াদ নিয়ে উপদেষ্টারা সুস্পষ্ট কিছু বলছেন না। তাঁরা বলছেন, নির্বাচনের আগে দরকার রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংস্কার, রাষ্ট্র রূপান্তর। গত বুধবার নয়াপল্টনে বিএনপি দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচন দাবি করলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংবিধানে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হলেও এই সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। পরদিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বাতিল করেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তিন দিন দেশ ছিল সরকারবিহীন। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত বৃহস্পতিবার রাতে শপথ নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যাশায় যাত্রা শুরু করা এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস, উপদেষ্টা রয়েছেন ১৬ জন। গতকাল শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টাসহ ১৪ জনের দপ্তর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তিনজন উপদেষ্টা ঢাকার বাইরে থাকায় বৃহস্পতিবার রাতে শপথ নেননি। তাঁদের দপ্তরও বণ্টন করা হয়নি।

এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চেয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেদিনই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পক্ষে মত দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ বা এমন সরকারের অধীনে নির্বাচনের সময়সীমা বিষয়ে কিছু বলা নেই। শুধু সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় অনুচ্ছেদের ১২৩(৩)(খ) ধারায় বলা হয়েছে, মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১২৩-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো দৈব দুর্বিপাকে সেটা সম্ভব না হলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

জানতে চাইলে গতকাল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সংবিধানে আসলে এ রকম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিধান নেই। এটা আমাদের জন্য নতুন ধারণা। ফলে সংবিধানের রেফারেন্স এখানে দেওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে এই সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে, তা আরও কিছু সময় পর বোঝা যাবে। দেখতে হবে জনগণ কী চায়, রাজনৈতিক দলগুলো কী চায়।’ তিনি বলেন, এই অন্তর্বর্তী সরকার হচ্ছে বাস্তবতা। প্রয়োজনীয়তার আলোকে উপদেষ্টাদের নির্বাচন দিতে প্রস্তুতি কতটুকু, আস্থা কতটুকু—এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে মেয়াদ নির্ধারিত হবে।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ডাক দেওয়া সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই সরকারের মেয়াদ তিন বছর করার প্রস্তাব দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছে। বিএনপি সংবিধান অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছে। বৃহস্পতিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অতি দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘একটা অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন চলতে পারে না। প্রত্যাশা করি, এই সরকার দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে স্বল্পতম সময়ে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করবে।’

সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কোনো নেতা প্রকাশ্যে নেই। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মোবাইলও বন্ধ। ফলে এ বিষয়ে তাঁদের কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে উপদেষ্টারাও সরাসরি কোনো মন্তব্য করছেন না। তাঁদের ভাষ্য, এখনো সরকারের মেয়াদ ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে এখনই আলোচনা করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া উপদেষ্টা ফরিদা আখতার সরকারের মেয়াদ-সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে পার্থক্য আছে। আগে একটা সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে নির্বাচন দেওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতো। তারা রুটিন ওয়ার্ক করত। কিন্তু এটা গণ-অভ্যুত্থান এবং আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত সরকার। কাজেই এর প্রধান কাজ নির্বাচন নয়। এর প্রধান কাজ হলো যে সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলোর সমাধান করা। নির্বাচন তার মধ্যে একটা। সময়মতো এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

একই প্রশ্নের জবাবে গতকাল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘মেয়াদের বিষয়ে এখনই আলোচনা করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। আপনি কী রিফর্ম (সংস্কার) চান, সেটা না বুঝে তো আমি মেয়াদের কথা বলতে পারব না। রিফর্ম যদি আপনারা না চান, তাহলে আরেক কথা। কাজেই এখনই মেয়াদ মেয়াদ করে অস্থির হওয়ার কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই গণতান্ত্রিক দেশে যাতে যাত্রা শুরু করতে পারি, সেটার প্রস্তুতির জন্যই তো অন্তর্বর্তী সরকার। সে প্রস্তুতির জন্য যেটুকু সময় দরকার, শুধু সেটুকু সময়ই আমরা নেব। শেষ পর্যন্ত আমাদের গণতন্ত্রেই যেতে হবে।’

গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘এ (মেয়াদ) বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের যেহেতু গণ-অভ্যুত্থানের ভিত্তিতে গঠিত একটি সরকার এবং অনেক সংস্কারের কথা আমরা বলেছি, সেগুলো আমাদের করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সেটা যত দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্ভব, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার মধ্যে এনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এই সরকারের মেয়াদ শেষ করব।’

অন্তর্বর্তী সরকারের আরেক উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অপর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে এ সরকার কাজ করবে। কিন্তু তার আগে নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কার করা হবে। না হলে জনগণের অধিকার লঙ্ঘিত হবে।

বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের দ্রুত নির্বাচন দাবির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে শপথের পর উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ওনারা (রাজনীতিবিদ) দাবি করতেই পারেন। তাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা দাবি করবেনই, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওনাদেরও বুঝতে হবে, ওনারা ১৫-২০ বছর কিছুই করতে পারেননি। ছোট ছোট বাচ্চারা করেছে, তারা রক্ত দিয়েছে, সফলতা এনেছে। কাজেই এটা ছিনতাই করার কোনো কারণ নেই।’

Share