সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা

আনোয়ারা পারভীন : দেশের অর্থনীতি ডলারের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বছর জুড়ে টাল মাতাল অবস্থা। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে অভ্যন্তরীণ এ সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ দুই অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই করছে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ৩৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ করেছে। বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া সত্ত্বেও রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।

অনেক দিন ধরে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোও নেতিবাচক ধারাতেই রয়েছে। এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারে ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতেই দেশের অর্থনীতি আবারও ধাক্কা খেল। দীর্ঘদিনের সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সৃষ্ট অচলাবস্থা। এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি ব্যবসাবাণিজ্য ও সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য চরম হুমকি বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, এক সপ্তাহে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হবে।

সপ্তাহ জুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ই-কমার্সে দিনে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্দোলনের অচলাবস্থা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আরও উসকে দিয়েছে। এর ফলে নতুন করে বেড়েছে অনেক পণ্যের দাম। যা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে সামনের সময়গুলোয় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর এই পরিস্থিতি অস্বস্তিকর চাপ সৃষ্টি করবে। টানা এক সপ্তাহের ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের পর সীমিত পরিসরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হলেও পুরোদমে চালু হতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে কারফিউও চলমান রয়েছে। জনমনে স্বস্তি এলেও পুরো পরিস্থিতি অনুকূলে না আসা পর্যন্ত সরকারও পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় রয়েছে।

আর্থিক সংকটের কারণে টানা কয়েক বছর ধরে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগেও অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক দিন পর রপ্তানি খাত কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই ছাত্র আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতা বিদেশি ক্রেতাদের কাছে আবারও নেতিবাচক ইঙ্গিত পৌঁছাল। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য সরকার সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কাঙ্খিত হারে বাড়ার কোনো সুযোগ নেই।

টানা কয়েক দিনের ধ্বংসসজ্ঞে দেশের অবকাঠামো খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা পুড়িয়ে দেওয়ায় উড়ালসড়ক বন্ধ রাখা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। মেট্রোরেল চালুর এক বছরের মধ্যেই বড় ধরনের ধাক্কা খেল। যেসব স্টেশন ভাঙচুর করা হয়েছে, সেগুলো মেরামত করে আবারও পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এক বছরের বেশি লাগবে বলে জানিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটডে (ডিএমটিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে। আবার মেট্রোরেল বন্ধ থাকায় সরকার রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোটা সংস্কার নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির পুরো সময়ই বেচাকেনা কম ছিল। ঢাকার অধিকাংশ মার্কেট ও শপিং মলে ছিল ক্রেতাশূন্য। কারফিউ জারির পর বন্ধই হয়ে যায় সব শপিং মল ও দোকানপাট। এতে প্রতিদিন ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া আন্দোলনের এ সময়টায় দেশের বিভিন্ন বন্দরের কার্যক্রম মঙ্গলবার পর্যন্ত পুরোপুরি বন্ধ ছিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, গত বছর দেশের ৪৩ শুল্ক স্টেশন দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৬ হাজার পণ্য চালান রপ্তানি হয়েছে। এ হিসাব আমলে নিলে গত ৫ দিনে প্রায় ৩০ হাজার চালান বন্দরে আটকা রয়েছে। যার একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে।

Share