সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ভাসমান খাঁচায় কোরাল চাষে সফলতা

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি : দেশে প্রথমবারের মতো ভাসমান খাঁচায় কোরাল বা ভেটকি মাছ চাষে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।

গবেষকেরা বলছেন, দেশে কোরাল চাষের বড় বাধা ছিল উপযুক্ত পোনা ও কৃত্রিম খাদ্যের অভাব। কিন্তু সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করে ‘রাক্ষুসী’ প্রকৃতির এই সামুদ্রিক মাছ চাষে সফল হয়েছেন তাঁরা, যা উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য টেকসই আয়ের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার তথ্য জানান এই গবেষণার প্রধান গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহজাহান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশ ইকোফিজিওলজি ল্যাবরেটরিতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এবং মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সাসটেইনেবল কোস্টাল মেরিন ফিশারিজ (এসসিএমএফপি) প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী জাবেদ হাসান।

গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে প্রধান গবেষক জানান, প্রথমবারের মতো ভাসমান খাঁচায় সামুদ্রিক ভেটকি মাছ চাষ ও সম্পূরক কৃত্রিম খাদ্য ব্যবহারের কার্যকারিতা যাচাই করা ছিল গবেষণার মূল লক্ষ্য। গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া হয় সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ, কক্সবাজারের মহেশখালী ও ভোলার চর কুকরি-মুকরির উপকূলীয় অঞ্চল। মাছ চাষের খাঁচা তৈরি থেকে শুরু করে চাষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে এসব অঞ্চলের স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সরাসরি সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এতে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে শুধু চাষের প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়েনি, দক্ষতাও তৈরি হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গবেষণার আওতায় মাছ চাষ শুরু হয় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, শেষ হয়েছে একই বছরের ডিসেম্বের। তবে গোটা প্রকল্পের কাজ শেষ করতে লেগেছে দেড় বছরের মতো। গবেষকেরা জানান, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নার্সিং পর্যায়ে আলাদা জায়গায় মাছের প্রাথমিক বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়। পরে খাঁচায় স্থানান্তর করে পূর্ণাঙ্গ চাষ শুরু হয়। প্রতিটি বৃত্তাকার খাঁচার ব্যাস ৬ দশমিক ৭ মিটার। ৬০ ঘনমিটারের এই খাঁচায় প্রতি ঘনমিটারে ১৫টি করে পোনা ছাড়া হয়। দেশে বাণিজ্যিকভাবে কোরাল পোনা উৎপাদিত হয় না। তাই গবেষণার জন্য থাইল্যান্ড থেকে পোনা আনতে হয়েছে।

গবেষক জানান, ‘রাক্ষুসী’ প্রকৃতির এই মাছকে শুরুতে খাওয়ানো হয়েছে কুচি করা তেলাপিয়া মাছ। ধীরে ধীরে খাদ্যব্যবস্থায় যুক্ত করা হয়েছে বাণিজ্যিক কৃত্রিম খাবার (৪৫ শতাংশ আমিষ)। আর শেষে ব্যবহৃত হয়েছে গবেষণাগারে প্রস্তুত ৩৭ শতাংশ আমিষযুক্ত সম্পূরক খাদ্য। কৃত্রিম খাদ্য ব্যবহারের পরও মাছের যথেষ্ট বৃদ্ধি হয়েছে। মাছের পুষ্টিগুণেও কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়নি। গবেষকেরা মাছের পাকস্থলী পরীক্ষা করে মাছের খাদ্য গ্রহণ ও রূপান্তরের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করেন। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, খাঁচায় চাষের ফলে পুষ্টিমানে কোনো ঘাটতি হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রতিটি খাঁচায় ৮০০ থেকে ৮৫০ কেজি মাছ উৎপাদিত হয়েছে। প্রতি ঘনমিটারে (খাঁচার গভীরতা দেড় মিটার ধরে) উৎপাদন হয়েছে ১৩ থেকে ১৭ কেজি, যা প্রতি হেক্টরে হিসাব করলে ২০ হাজার কেজি থেকেও বেশি হয়। অন্যদিকে পুকুর বা ঘেরে প্রচলিত পদ্ধতিতে গড়ে প্রতি হেক্টরে উৎপাদিত হয় ৬০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কেজি। খাঁচায় চাষ করা মাছে প্রতি ১০০ গ্রামে গড় আমিষের পরিমাণ ১৯ গ্রাম, যেখানে প্রচলিত কোরালে এই পরিমাণ ১৭ গ্রাম।

গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি ১ টাকা বিনিয়োগে গড়ে ১ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত আয় সম্ভব। প্রতিটি খাঁচা নির্মাণে খরচ হয়েছে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা, যেটি প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য। একেক খাঁচায় একবারে ১ হাজার কেজি পর্যন্ত মাছ চাষ সম্ভব। বর্তমানে প্লাস্টিক দিয়ে খাঁচা তৈরি করা হলেও প্রান্তিক মৎস্যচাষিরা চাইলে বাঁশ বা সাধারণ জাল দিয়েও এটি তৈরি করতে পারবেন। এতে করে খরচ আরও কমানো সম্ভব।

অধ্যাপক মো. শাহজাহান বলেন, ‘এই চাষপদ্ধতিতে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি কম, প্রাকৃতিক দুর্যোগেও কম ক্ষতি হয় এবং মাছ একে অপরকে খেয়ে ফেলার আশঙ্কাও থাকে না। প্রতি লিটার পানিতে ৩৫ মিলিগ্রাম লবণাক্ততা পর্যন্ত এই মাছ সহজে বেঁচে থাকতে পারে। তাই বাংলাদেশের উপকূলীয় নদী ও মোহনায় এই মাছ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি নদীতে খাঁচা করা যাবে, যে কারণে জায়গার জন্য আলাদা টাকা খরচ করতে হবে না মাছচাষিকে।’ ‘এটি শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয় বরং উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন জীবিকার পথ’—বললেন এই গবেষক।

Share