নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : দেশে করোনা সংক্রমণ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এর প্রকোপ রুখতে জনজীবন স্থবির করা কঠোর লকডাউনের মধ্যেই এক দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আর মৃত্যুতে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড দেখতে হল বাংলাদেশকে। সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩৪ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে ৯ হাজার ৯৬৪ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে আরও ১৬৪ জনের প্রাণ গেছে এ ভাইরাসের কারণে। যা দেশে মহামারিকালের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত ও মৃত্যু।
বর্তমানে করোনা সংক্রমণ প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে। আর সংক্রমিতদের অর্ধেকই গ্রামাঞ্চলের। জেলা-উপজেলায় ইতিমধ্যে অক্সিজেন সংকট দেখা দেওয়ায় রোগীরা চিকিৎসাসেবা পেতে রাজধানীতে ছুটছেন। সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত খাকলে সামনে অক্সিজেনের তীব্র সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা।
প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। প্রয়োজন মেটাতে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন জেনারেটর ক্রয়ের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সারাদেশে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছেন করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ।
করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার দুটি উপায়ের একটি হলো লকডাউন, অন্যটি ভ্যাকসিন। রাজধানীসহ শহর এলাকার মানুষ সচেতন হওয়ায় চলমান লকডাউনের সুফল পাওয়া গেছে। তবে গ্রামের মানুষ সচেতন নয়। তারা মাস্ক পরে না, স্বাস্থ্যবিধি মানে না, মোড়ে মোড়ে আড্ডার সমাগম চলে। গ্রামের হাট-বাজারেও জনসমাগম প্রচুর। এ কারণে বর্তমানে গ্রামের মানুষ বেশি সংক্রমিত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে করোনা শনাক্তের হার ৩০ থেকে ৭০ ভাগ। এছাড়া গ্রামের মানুষ করোনার উপসর্গ হলে সাথে সাথে চিকিত্সা সেবা নেন না। দেরিতে এমন সময় হাসপাতালে যান, তখন তার অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। আর গ্রামাঞ্চলে রয়েছে অক্সিজেনের সংকট। চিকিৎসা সেবাও তেমন নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কমিউনিটিতে ছড়িয়ে গেছে। সংক্রমণ গ্রামের লোকজনের মধ্যে বেশি হচ্ছে। আমাদের কাছে যে হিসাব আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি লোক গ্রাম থেকে আসছে। আবার অনেকেই করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হলেও সাধারণ সর্দি-জ্বর বা কাশিতে আক্রান্ত বলে ধরে নিচ্ছেন। পরীক্ষা করাচ্ছেন না, বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না। পরে রোগের তীব্রতা বাড়লে হাসপাতালে যাচ্ছেন।
করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, আমরা করোনা মোকাবেলা করতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে দুই সপ্তাহ লকডাউন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। সরকার প্রথমে এক সপ্তাহ দিয়েছে, পরবর্তীতে তা আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়েছে। দুই সপ্তাহ পরে হয়তো সংক্রমণ কিছুটা কমে যাবে। তবে এটা নির্ভর করছে সামনে গরুর হাট ও ঈদ উদযাপনে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর। তিনি বলেন, গ্রামে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, কারণ গ্রামের মানুষ সচেতন নয়। মাস্ক পরে না, মোড়ে মোড়ে সমাগম করে। গ্রামের মানুষদের স্বাস্থ্যবিধি মানাতে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি সারাদেশে ফিল্ড হাসপাতাল করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, গ্রামের স্কুল-কলেজে এই হাসপাতাল তৈরি করা যায়।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব এনেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, যেহেতু সংক্রমণের হার বাড়ছে, তাই সামনে অক্সিজেনের সংকট দেখা দেবে। ৭০ লিটার অক্সিজেন ১৫ থেকে ২০ জন সাধারণ রোগীকে দেওয়া যায়। কিন্তু করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে এক জনের জন্য প্রতি মিনিটে ৭০ লিটার অক্সিজেন লাগে। হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা দিয়ে এই অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। তবে সারাদেশে হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা নেই। গ্রামে করোনা রোগী বেশি। সেখানে হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা বেশি প্রয়োজন। ওয়ার্ড পর্যায়ে হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন পর্যায়ে উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও উপজেলা পর্যায়ে হেলথ কমপ্লেক্স থাকলেও সেখানে হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা নেই। অনেক জেলা সদর হাসপাতালেও নেই। এই অবস্থায় যেভাবে রোগী বাড়ছে, তাতে সামনে অক্সিজেনের সংকট দেখা দেবে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন জেনারেটর ক্রয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। অক্সিজেন জেনারেটর দিয়ে বাতাসের সাহায্যে অক্সিজেন উৎপাদন করা হয়।
অক্সিজেন জেনারেটর ক্রয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, বিভিন্ন জায়গায় অক্সিজেনের সংকট হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তরিত্ ব্যবস্থা নেওয়া নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, গ্রামে জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ স্কুল-কলেজগুলোতে ফিল্ড হাসপাতাল করা যেতে পারে। প্রয়োজনে বেকার ৪০ হাজার ডাক্তার ও সমসংখ্যক নার্সদের নিয়োগ দিয়ে এই ফিল্ড হাপসাতালে পদায়ন করতে হবে। বাসায় চিকিৎসা না নিয়ে ফিল্ড হাসপাতালে একজন চিকিত্সক ও নার্সের অধীনে অক্সিজেন নেওয়াই উত্তম। কারণ অক্সিজেনের লেভেলের বিষয়টি নার্সরা বুঝবেন। একই সঙ্গে তিনি করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গণহারে টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ওয়ার্ড পর্যায়ে হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন পর্যায়ে উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, উপজেলা পর্যায়ে হেলথ কমপ্লেক্স ও জেলা পর্যায়ে সদর হাসপাতাল রয়েছে। স্বাস্থ্যে এতো বিশাল অবকাঠামো যদি সুন্দরভাবে কাজ করতো, তাহলে রোগীদের আর রাজধানীতে আসা লাগতো না। উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিলে করোনার প্রায় ৯০ ভাগ রোগীকে সুস্থ করা যায়। আর এসব চিকিৎসক ওয়ার্ড পর্যায়ের হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিকেই দেওয়া সম্ভব। কিন্তু ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ের করোনা রোগীরা তেমন চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এসব মনিটরিংও করা হয় না। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা থাকেন উচ্চ পদ দখলে নেওয়ার ধান্ধায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালক, যিনি কেনাকাটার দায়িত্বে, তাকে তো খুঁজেই পাওয়া যায় না।
সম্প্রতি সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবেলায় যা প্রয়োজন তার সবই করা হবে বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে সবাই স্বস্তি পেয়েছেন। তবে মন্ত্রণালয় থেকে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যের পুরো অবকাঠামোর দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের ব্যর্থতার জন্য পরিস্থিতির অবনতি হলে তার দায়ভার তাদেরই নিতে হবে। করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির একজন সদস্য বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন মাঠ পর্যায়ের করোনার যে তথ্য তুলে ধরছে, তার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের সঠিক চিত্রের কোন মিল নেই। কারণ বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জনরা হাসপাতালে যান না, সঠিক তথ্য পাঠান না। প্রসঙ্গত, গ্রাম থেকে আসা রোগীদের চাপে রাজধানী ঢাকার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোন আইসিইউ বেড বর্তমানে ফাঁকা নেই।
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, গ্রামাঞ্চলে করোনায় সংক্রমিত রোগী বেশি। রাজধানীসহ শহর এলাকায় কম সংক্রমিত হচ্ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে গ্রামাঞ্চলে লকডাউন বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে গ্রামে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে বেকার ডাক্তার-নার্সদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। নইলে সামনে ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, গ্রামে করোনা সংক্রমণের উৎস বন্ধ করতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর দায়িত্ব দিতে হবে জনপ্রতিনিধিদের। আর এক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে প্রশাসন। এটা করলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি বলেন, সীমান্তে যখন সংক্রমণ বাড়ে, তখন আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। সেখান থেকে যখন সারাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে, তখনই আমাদের টনক নড়েছে। সামনে এখন ভয়াবহ বিপদ ।
দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা গত ২৭ জুন থেকেই একশর উপরে থাকছিল প্রতিদিন। এর মধ্যে জুলাইয়ের প্রথম দিন ১৪৩ জনের রেকর্ড মৃত্যুর খবর আসে। ৪ জুলাই তা ছাপিয়ে ১৫৩ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরদিনই দেশে ১৬৪ জনের রেকর্ড মৃত্যু হল। ৩০ জুন রেকর্ড ৮৮২২ জন রোগী শনাক্ত হন। গতকাল সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮১ জনে। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে মোট ১৫ হাজার ২২৯ জনের। গত এক দিনে কেবল ঢাকা বিভাগেই ৪২৫০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা দিনের মোট শনাক্তের প্রায় ৪২ শতাংশের বেশি।
চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং খুলনা বিভাগেও হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। খুলনায় শনাক্তের হার ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বরিশালে শনাক্তের হার ৫৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। নতুনা পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাড়ছিল। সোমবার তা ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত বছরের আগাস্টের পর সর্বোচ্চ। ওই সময় ৩ অগাস্ট শনাক্তের হার ছিল ৩১ দশমিক ৯১ শতাংশ। তার আগে গত বছরের ১২ জুলাই দৈনিক শনাক্তের হার পৌঁছেছিল ৩৩ দশমিক শতাংশে যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। আর যে ১৬৪ জন গত এক দিনে মারা গেছেন, তাদের ৫৫ জনই ছিলেন খুলনা বিভাগের বাসিন্দা। ঢাকা বিভাগে মৃত্যু হয়েছে আরও ৪০ জনের। মৃত ১৬৪ জনের মধ্যে ৮৩ জনেরই বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি।
খুলনা অফিস জানায়, খুলনা মহানগরের করোনা হাসপাতালে গত সপ্তাহে অক্সিজেনের তীব্র সংকট থাকলেও চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে এ সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। তবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে অক্সিজেনের তীব্র সংকট। ফলে করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গের অনেক রোগী খুলনার হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছেন। কিন্তু খুলনা মহানগরীর হাসপাতালগুলো রোগীতে পরিপূর্ণ থাকায় এখানেও ভর্তি হতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাদের।