নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : সিলেট অঞ্চলের ‘আইলা রে নয়া দামান’ গানটি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আলোচনার ঝড় তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা তরুণ কম্পোজার মুজাহিদুর আব্দুল্লাহের (মুজা) সংগীত আয়োজনে তোশিবা বেগমের গাওয়া গানটির নতুন সংস্করণ ‘নয়া দামান’ ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর মূল গানটিও আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
মুজা ও তোশিবার নতুন সংস্করণটিতে দেখা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের তিন ডাক্তার নাচছেন এ গানটির সঙ্গে। তবে এই গানের দৃশ্যায়নের কোথাও মূল গীতিকার ও সুরকারের উল্লেখ নেই, যা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ গানটি অনেক আগে থেকেই সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন বিয়ে ও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়ে আসছে এবং বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে এর অন্তত ছয়টি সংস্করণ বা ভার্সন রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে গবেষক-বিশেষজ্ঞরাও গানটির উৎপত্তি ও এর মূল গীতিকার-সুরকার এবং প্রথম গায়ক বা গায়িকা নিয়ে পড়েছেন সিদ্ধান্তহীনতায়। তারা বলছেন, ‘এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়া যাবে না। এর জন্য সময় প্রয়োজন।’
একুশে পদকপ্রাপ্ত পণ্ডিত রামকানাই দাশের কণ্ঠেও গানটি একটি অ্যালবামে রেকর্ড হয়েছে। সিলেটের সুনামগঞ্জের এই শিল্পী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘লোককবি দিব্যময়ী দাশ ‘আইলারে নুয়া জামাই’ গানটি লিখেছিলেন। স্বামী রসিকলাল দাশের সঙ্গে বসে তিনি গান বাঁধতেন।’ এই দিব্যময়ী দাশ ও রসিকলাল দাশের সন্তানই পণ্ডিত রামকানাই দাশ ও একুশে পদক পাওয়া আরেক বরেণ্য লোকসংগীত শিল্পী সুষমা দাশ।
পণ্ডিত রামকানাই দাশের ছোট ছেলে পিনুসেন দাশ বলেন, ‘গানটি সিলেট বেতার কেন্দ্র থেকে শিল্পী ইয়ারুন্নেসা খানম প্রথম রেকর্ডিং করেন। তিনি আমার বাবার কাছে গান শিখতেন। আমাদের ঠাকুমা (দিব্যময়ী) আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। ঠাকুমার কাছে থেকে ইয়ারুন্নেসা গানটি শিখেছিলেন। সেটি ১৯৭২ বা ’৭৩ সালের দিকের কথা।’
তিনি বলেন, ‘বাবা রামকানাই দাশ বেঙ্গলের অ্যালবামে এ গানটি রেকর্ড করেছিলেন। সেখানে গানের মধ্যেই পদকর্তা দিব্যময়ী দাশের নাম রয়েছে (ভনিতা)। এই গানে একটি লাইন আছে পাড়ার লোকে দেখতে আইল দিব্যময়ীর বিয়া’।’
কাবেরী দাশ বলেন, ‘এই গানটি নিয়ে কেন বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, বুঝতে পারছি না। গানটি আমার ঠাকুরমারই গান। এটি আমরা ছোটবেলায় বহুবার গেয়েছি। আমার ঠাকুরমা-ঠাকুরদা দুজনেই গান লিখতেন ও গাইতেন।’
তিনি বলেন, ‘রেডিওতে তখন এ গানে ঠাকুরমার নাম বলা হয়নি, কারণ তিনি অ্যানলিস্টেড (নিবন্ধিত) গীতিকার ছিলেন না। তাই তখন গীতিকারের নাম ‘অজ্ঞাত’ বলা হয়েছিল। কিন্তু গানটি তো ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকেই আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত। এখন অন্যকেউ যদি কথা বদলে গানটি গায়, সেটি তো দিব্যময়ীর দোষ না।’
গানের কথা পরিবর্তন নিয়ে কাবেরী দাশ বলেন, ‘ঠাকুরমার গানে একটা লাইন আছে- ‘বাজায় বাঁশি জয় রাধা বলিয়া’। ইয়ারুন্নেসা যখন রেডিওতে গাইতে গেলেন, তখন কর্তৃপক্ষ বললেন, ‘রাধা’ বলা যাবে না। তখন ‘জয় রাধা বলিয়ার বদলে ‘আমার নাম বলিয়া’ গাওয়া হয়েছে। এমন অনেক ঘটনাই আছে। বাবার কাছে শুনেছি, অনেক গানেরই কথা বদলে দেওয়া হতো।’ এভাবেই ‘নুয়া জামাই’ কথাটি ‘নয়া দামান’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে বের হওয়া অ্যালবামে দিব্যময়ীর নাম ব্যবহার করেননি রামকানাই দাশ। সেখানে গানটির গীতিকার ও সুরকারের জায়গাটিতে ‘সংগৃহীত’ লেখা হয়েছে বলে জানান এই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা।
মূল গীতিকার কে বলা ‘কঠিন’: সিলেট অঞ্চলের লোকগানের বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেটের ধামাইল গানে ভনিতা (পদকর্তার নাম থাকা) থাকলেও বিয়ের গানগুলোতে সাধারণত ভনিতার ব্যবহার দেখা যায় না। তাই বিয়ের গান হওয়ার পরও এতে ভনিতা যুক্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে কেউ স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারছেন না। কেউ কেউ গানটির গীতিকার হিসেবে গিয়াসউদ্দিন আহমেদ কিংবা সিদ্দিকুর রহমানের নাম বলেছেন। তবে গবেষকদের মতে, গানটি তাদের হওয়ার সম্ভাবনা কম।
লোকসাহিত্য গবেষক সুমনকুমার দাশ বলেন, ‘আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গুণী সংগীতজ্ঞ রামকানাই দাশ গানটি তার মায়ের লেখা বলে জানিয়েছেন। আমার লেখা ‘রামকানাই দাশের নন্দনভুবন :একটি অন্তরঙ্গ আলাপ’ বইয়ে সাক্ষাৎকারটি আছে। পরে কয়েকজন জানান, এটি প্রাচীন বিয়ের গীত। এরপর গানটি সম্পর্কে আমি খোঁজখবর নিই।’
গানটি নিয়ে নিজের অনুসন্ধানের বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আইলা রে নয়া দামান/আসমানেরও তেরা/বিছানা বিছাইয়া দেও/শাইল ধানের নেড়া’ স্থায়ী অংশটি ভাষাতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বিচারে একটি বিয়ের গীত। দীর্ঘদিন ধরে এ গানের স্থায়ী অংশটুকু এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। এই স্থায়ী অংশের কিছু শব্দ অদলবদল করে অন্য অন্তরাগুলো একেক শিল্পী একেকভাবে গাইছেন। যদিও গানের বিষয়বস্তু মূলত এক। আমি অন্তত এ গানের ছয়টি পাঠ (ভার্সন) সিলেট অঞ্চলে পেয়েছি। প্রতিটি গানের অন্তরায় ভিন্ন শব্দ বা পঙ্ক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ৯৫ শতাংশ গানগুলোতে ‘জামাই’ শব্দটির বদলে ‘দামান’ ব্যবহার করা হয়েছে।’
সুমনকুমার দাশ জানান, ‘এই গানটির স্থায়ী অংশটি অন্তত ৫৫ থেকে ৬০ বছর ধরে এ অঞ্চলে প্রচলিত। এই স্থায়ীকে কেন্দ্র করেই অনেক লোককবি বা গীতিকারেরা গানটি পুনর্নির্মাণ করেছেন। প্রচলিত গানে সিলেট আর মৌলভীবাজারের অনেক শব্দ রয়েছে। অন্যদিকে দিব্যময়ী দাশের গানে কিছু কিছু শব্দ আছে, যা সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের। আবার কিছু পাঠে হবিগঞ্জ অঞ্চলের মৌখিক উপভাষার ব্যবহারও দেখা গেছে। মূলত যে অঞ্চলে গানটি গাওয়া হয়েছে, সে অঞ্চলের শব্দ এতে ঢুকে গেছে। লোকগানের সব বৈশিষ্ট্যই এই গানটিতে আছে। দিব্যময়ী দাশ হয়তো প্রচলিত গানটিকে তার মতো করে পুনর্নির্মাণ করেছেন, অন্যরাও করেছেন। এ কারণেই একাধিক পাঠ পাওয়া যাচ্ছে গানটির। এর পরও বিস্তর গবেষণা ও যাচাই-বাছাই ছাড়া গানটির বিষয়ে প্রকৃত সিদ্ধান্তে আসা কঠিন।’
সিলেটের প্রবীণ সংগীতশিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস দীর্ঘদিন কাজ করেছেন সংগীতজ্ঞ রামকানাই দাশের সঙ্গে। বর্তমানে এ অঞ্চলের অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পী তিনি। এক আলাপে সমকালকে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে রামকানাই’দার (রামকানাই দাশ) সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। আমরা একসঙ্গে কিছুদিন সংগীতজ্ঞ ও লোকগানের গুরু বিদিত লাল দাসের দলেও ছিলাম। কিন্তু তখন তিনি একবারের জন্যও এই গানটির রচয়িতা হিসেবে নিজের মায়ের কথাটি আমাকে বলেননি। সাক্ষাৎকারে উনি কী বলেছেন তা আমি জানি না, শুনিওনি।’
‘নয়া দামান’ গানের স্মৃতি উল্লেখ করে হিমাংশু বিশ্বাস বলেন, ‘১৯৭৩ বা ১৯৭৫ সালে লোকগানের আন্তর্জাতিক একটা সম্মেলন হয়েছিল। জসিমউদ্দিন সাহেবও (পল্লিকবি জসিম উদ্দীন) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে সিলেটের লোকসংগীতের ৫০ মিনিটের একটি সেশন ছিল। সেই সেশনে ‘নয়া দামান’ গানটি আমরা গেয়েছি। সেখানে কথা ও সুর ‘সংগৃহীত’ বলা হয়েছে। বর-কনে সাজিয়ে গানটিকে চিত্রায়িত করা হয়েছিল, টেলিভিশনেও দেখানো হয়েছে, তখনও উনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।’
কপিরাইট অফিসে খোঁজ নিয়েও জানা গেছে, গানটির স্বত্ব পেতে এখনও কেউ কোনো আবেদন করেননি।