স্বজনের কথা বাবা বলতেন দেশ একদিন স্বাধীন হবেই

ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া : আমার বাবা শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ুম। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন।আমি মা আয়েশা আক্তার খানম ও পিতা মীর সুবেদ আলীর তৃতীয় সন্তান। আমার বাবার জন্ম ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওয়ের ঘাগরা গ্রামের মীর বাড়িতে। তিনি ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। আমার মা মাসতুরা খানম। তিনিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা ছিলেন। আমার বাবা-মা সহপাঠী ছিলেন। আমরা দুই ভাই, দুই বোন। বাবার ডায়েরি থেকে জেনেছি তিনি ছাত্ররাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। গবেষণার কাজে মা-বাবা দু’জনের ওই সময় কানাডা যাওয়ার কথা ছিল। মায়ের কাছে শুনেছি বাবা খুব অতিথিপরায়ণ ছিলেন। তিনি মাছ খেতে পছন্দ করতেন। গল্প শুনে জানি, বাবা আমাদের প্রতি খুব কেয়ারিং ছিলেন। স্পষ্টভাষী স্বতঃস্ম্ফূর্ত মানুষ ছিলেন। যা বিশ্বাস করতেন তা শক্তভাবে বলতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি গোপনে সাহায্য করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ সরবরাহ করাসহ অর্থের জোগান দিতেন। তিনি সরাসরি বিভাগের সবার সামনে বলতেন- এই বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই।

১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের স্টেনোগ্রাফার তৈয়ব আলী বাবাকে বাসা থেকে বাইরে ডেকে নিয়ে যান। তাকে বলেন, আপনাকে একজন মিলিটারি অফিসার ডাকছেন। রাত তখন ৮টা বাজে। সেদিন তার শরীরটা একটু খারাপ ছিল। গায়ে জ্বর ছিল। তিনি একটি শার্ট গায়ে দিয়ে মাকে ‘আমি একটু আসছি’ বলে তার আইডি কার্ডটি হাতে নিয়ে বের হয়ে যান। আইডি কার্ডটি নিয়ে বের হওয়ার পর মায়ের মনে হলো তিনি কোথায় গেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমার মা তার পেছনে পেছনে যেতে শুরু করেন। তাকে ডাকতে থাকেন। পেছন থেকে যখন ডাক দিলেন তখন দেখলেন একটা সাদা জিপ গাড়ি আমার বাবাকে তুলে নিয়ে গেল। তারপর বহু খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সেদিন রাতেই রাজশাহীর ১৪ জনকে একসঙ্গে তুলে নিয়ে পদ্মা নদীর তীরে বালুর চরে (বোয়ালিয়া অফিসার্স ক্লাবের কাছে) শ্রীরামপুর নামের একটা জায়গায় জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের প্রত্যেকের হাত পেছন থেকে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। তাদের গায়ে কোনো বুলেটের চিহ্ন ছিল না। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর পদ্মার চরে বালুর মধ্যে একজন লোক একটা হাত দেখতে পায়। পরে সেই বালুর ভেতর থেকে একসঙ্গে ১৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। শীতকাল হওয়ায় বালুর ভেতর লাশগুলোর চেহারা বিকৃত হয়নি বলে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। বাবাকে কাদিরগঞ্জ গোরস্তানে সমাহিত করা হয়।

বিজয় অর্জনের মাত্র কয়েকদিন আগে ২৫ নভেম্বর যখন পুরো দেশ প্রায় মুক্তির পথে সেই সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আমার বাবা বুদ্ধিজীবী হত্যার সেই তালিকাভুক্ত ছিলেন। আর সেই নীলনকশা অনুযায়ী তাকে কৌশলে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়নকারীদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন সময়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অবাঙালি শিক্ষক মতিয়ূর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি আব্দুল বারী, আইন বিভাগের জিল্লুর রহমান, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ওয়াসিম বাঘী, ভাষা বিভাগের কলিম সাসারামি, অর্থনীতি বিভাগের সোলায়মান মণ্ডল, রেজিস্ট্রার জোয়ার্দারসহ আরও কয়েকজন তালিকাভুক্ত কোলাবোরেটর। তারাই এই হত্যার নীলনকশা তৈরি করে জোহা হলে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করে। স্বাধীনতার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে যুদ্ধাপরাধীর দায়ে এসব শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়। তাদের জেলে নেওয়া হয়। পরে তারা জেল থেকে বেরিয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করেছে, এমনকি তাদের পুরস্কৃত হতেও দেখেছি। তাদের ক্ষমতায় যেতে দেখেছি। নিজের চোখের সামনে তাদের পুনর্বাসিত হতে দেখেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও আমরা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সামাজিক ঘৃণাটা দেখতে পাইনি। যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করেন তাদেরও ক্ষমতার কাছে আপস করতে দেখেছি। যা শহীদ বাবার সন্তান হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার, অনেক কষ্টের, অপমানের, ক্ষোভের।

আমরা আশা করতাম, আমার বাবার মতো যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, পুরো জাতি তাদের সম্মান করবে; কিন্তু আমার বাবার হত্যাকারীরা স্বাধীনতা-উত্তরকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে গেছে। যেন তারা কোনো অপরাধই করেনি। তাদের বিষয়ে রাষ্ট্র থেকেও কোনো হস্তক্ষেপ হয়নি। এটিও আমাদের দেখতে হয়েছে। খুবই দুঃখজনক যে, যারা যুদ্ধাপরাধী, যারা আমার বাবাকে হত্যা করেছে বা হত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল সেই মানুষগুলোকে পুরস্কৃত করা হলো। এ মানুষগুলো সমাজে আবার গ্রহণযোগ্য হয়ে গেল, তাদের বিচারের কথা সবাই ভুলে গেল, আমাদের এই রকম কষ্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে, অসম্মানের অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হতে হয়েছে। আমার বাবার হত্যাকারীরা পুরস্কৃত হয়েছে, হত্যাকারীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়েছে, এগুলো আমাদের দেখতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে। যখন যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি চারদিকে ঘৃণা দেখতে পাই না, তাদের আলাদা করতে দেখি না, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করেছে, যারা আমাদের পিতাদের হত্যা করেছে তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ, শহীদ পরিবারকে এক কাতারে দেখি তখন মনে হয় আমার শহীদ বাবার এই ত্যাগ এই হারানোর বেদনা শুধুই আমাদের ব্যক্তিগত।

শহীদ বাবার সন্তান হিসেবে আমি চাই, দেশের মানুষ শহীদদের যথাযথ মর্যাদা ও মূল্যায়ন করুক। এ শ্রদ্ধা যেন শুধু মাঝে মাঝে বিশেষ দিবসগুলোতে উচ্চারিত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার উচ্চারণ না হয়। মানুষের মধ্যে সত্যিকারের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা তৈরি হোক। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সত্যিকারের ইতিহাসটা জানুক। হত্যাকারীদের ঘৃণা করুক এবং সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলাদেশের মাটিতে হোক। এখন বিচার হচ্ছে, তবে এ বিচার প্রক্রিয়া যেন শেষ হয়ে না যায়, কোনো বাধার মুখে না পড়ে। আমার মা এখনও বেঁচে আছেন। কিন্তু অনেক শহীদ পরিবারের মা আর বেঁচে নেই। তারা কিন্তু দেখে যেতে পারেননি তাদের স্বামীদের হত্যাকারীদের বিচার। তারা জীবনে অনেক বড় একটা সংগ্রাম করেছেন। এই স্বামীহারা মায়েরা জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অনেক যুদ্ধ করেই আমাদের পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি- আমার বাবাকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমার বয়স পাঁচ বছর, আমার ভাইয়ের ছয় বছর, আমার বোনের তিন বছর আর আমার ছোট ভাই তখন মায়ের গর্ভে। এই যে আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো, হত্যা করা হলো- শৈশবের এই ট্রমা আমাদের হঠাৎ করেই পরিপকস্ফ করে দিল। যেন বড় হয়ে গেলাম। আমাদের শৈশব হারিয়ে ফেললাম। এই ব্যক্তিগত হারানো, এই ক্ষত যারা আমার মতো সন্তান, তারাই এগুলো অনুভব করতে পারবে। তাদের সবারই একই অনুভূতি। এই শৈশবকালীন আঘাতের রেশ আমরা এখনও বয়ে বেড়াই।

আমার বাবার মতো যারা শহীদ হয়েছেন তারা সব রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকুক। দেশের মানুষ তাদের মনে শহীদদের প্রতি সত্যিকারের মর্যাদা ও ভালোবাসা প্রজন্ম পরম্পরায় ধারণ করুক।

লেখক: শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুমের কন্যা

Share