স্বজনের কথা হত্যাকারীরা ছিল হিংস্র জানোয়ার

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী : ১৯৭১ সালে পুরানা পল্টনের একটি বাসায় থাকতাম আমরা। বাসার নিচতলায় থাকত আলবদর সংগঠক মাওলানা আব্দুল মান্নান। তাকে ও তার কিছু সহযোগীকে আমরা চিনতাম। তারা নির্ধারিত পোশাক পরে ও অস্ত্র হাতে চারদিকে ঘোরাঘুরি করত। মান্নানের বাসা পাহারা দিত কয়েকজন আলবদর সদস্য। এ নিয়ে আমি ও আমার স্বামী ডা. আলীম চৌধুরী আপত্তি করি। আমরা পাহারাদারদের পরিচয় জানতে চাইলে মান্নান বলে, ‘এরা আমার ছাত্র এবং আলবদরের সদস্য। মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে চিঠি লিখেছে- ওপরে আলীম ভাই না থাকলে তোকে কবেই উড়িয়ে দিতাম। তাই আমি ভয়ে আছি এবং সেজন্য চারদিকে পাহারা রেখেছি।’ তখন আমার স্বামী আলবদর নেতা আব্দুল মান্নানকে বলেন- ‘এই পাহারাদাররা আমার গেটে থাকবে কেন, এরা আপনার গেটে থাকুক।’

আব্দুল মান্নান বলে, ‘পাহারাদাররা আপনার গেটেই থাকবে, কারণ মুক্তিযোদ্ধারা আসলে আপনার কাছেই আসবে এবং আপনার বাসা দিয়ে ঢুকেই আমাকে হত্যা করবে।’

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দিন গড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিজয়ও ত্বরান্বিত হতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায় আমরা দেখছিলাম মিত্র বাহিনী রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের আস্তানাগুলোতে বোমা ফেলছে। সেটা দেখে আমরা উল্লসিত হই। আমার স্বামী ডা. আলীম চৌধুরী হাসতে হাসতে বলছিলেন, বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মিত্র বাহিনী বোমা ফেলছে, তাদের মোকাবিলা করার সাধ্য পাকিস্তানিদের নেই। তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে আর ভাবছে হয়তো আমেরিকান সেনারা এসে তাদের বিজয়ী করবে। এটা অসম্ভব ব্যাপার। তখন পাকস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছিল। রেডিওতে সে ঘোষণাগুলো শুনে আমরা বুঝতে পারছিলাম দ্রুতই তারা আত্মসমর্পণ করবে।

১৫ ডিসেম্বরের সেই মুহূর্ত, তখন বিকেল সাড়ে ৪টা। আমাদের বাসার সামনে একটা গাড়ির শব্দ পেলাম। আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম একটা মাইক্রোবাস দাঁড়াল আলবদর নেতা আব্দুল মান্নানের গেটে। তখনও আমাদের মনে কোনো সংশয় ছিল না, কারণ তার বাসার গেটে সবসময়ই এ রকম গাড়ি আসে। অনেক সময় পাকিস্তানি আর্মিদের গাড়িও আসত। ফলে আমরা বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম। আমার স্বামী বললেন- দাঁড়িয়ে থেকো না, ভেতরে চলে যাও। তার কথামতো আমি ভেতরে চলে যাই। আধাঘণ্টা পর আমাদের তালাবদ্ধ গেটের কাছে প্রচুর শব্দ হয়। কয়েকজন দরজা খুলুন বলে চিৎকার করছিল। আমি জানালা খুলে নিচে তাকিয়ে দেখি আলবদরের পোশাক পরা অস্ত্রধারী তিনজন লোক দরজায় শব্দ করছে।

আমি ঘাবড়ে গিয়ে স্বামীর কাছে করণীয় জানতে চাই। তখন তিনিও ঘাবড়ে যান, তার মুখ কালো হয়ে যায়। দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেই তিনি আমাকে দরজা খুলে দিতে বললেন। এরপর তিনি দৌড়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। আমি তাকে আটকিয়ে কোথায় যাচ্ছেন তা জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন- ‘মান্নান সাহেবের কাছে যাচ্ছি।’ আমি বললাম কেন? তিনি বললেন, মান্নান আমাকে বলেছেন- ‘কেউ আসলে যেন তাকে জানাই।’ তখন আমি আর কিছু বললাম না। তিনি নেমে মান্নানের ঘরের দরজায় কড়া নাড়তে লাগলেন। মান্নান ওই দরজা কখনও বন্ধ রাখত না। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে সে ওই দরজা দিয়ে ওপরে উঠে আসবে। সেদিন সে দরজা বন্ধ রেখেছিল। ডা. আলীম দরজা খুলুন বলে আওয়াজ করছিলেন। আলবদর মান্নান দরজা না খুলে ভেতর থেকে বলেছিল- ‘আপনি যান, আমি আছি। কোনো ভয় নেই।’ ডা. আলীম বাসায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আলবদর সদস্যরা তাকে হাত ওপরে তুলতে বলে। তারা আগে থেকেই ডা. আলীমকে চিনত। তাই নামও জিজ্ঞাসা করেনি। আব্দুল মান্নান হয়তো তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল। আমার স্বামী ডা. আলীম আলবদর সদস্যদের বললেন- কী ব্যাপার? তারা বলল- আমাদের সঙ্গে চলুন। ডা. আলীম বললেন- ‘কোথায়’? তারা বলল- ‘আমাদের সঙ্গে গেলেই জানতে পারবেন।’ তিনি বললেন- ‘ঠিক আছে আমি কাপড় পরে আসি।’ তারা বলল- ‘তার আর দরকার হবে না।’ লুঙ্গি আর শার্ট পরা অবস্থায় তাড়াহুড়া করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।

সিঁড়ির ওপরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আশাপাশের লোকজন আমাকে বলল- ‘বেগম সাহেব, সাহেবকে তো ওরা নিয়ে যাচ্ছে।’ আমি ছুটে নামলাম। দেখলাম ডা. আলীমকে গাড়িতে ওঠানো হয়েছে। আমি অস্থির হয়ে দৌড়ে আলবদর নেতা আব্দুল মান্নানের কাছে গিয়ে বলি- ওরা আমার স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছে। তখন সে কোনো কথা বলল না। আমি বললাম- গাড়ি তো চলে যাচ্ছে, আপনি কিছু বলছেন না কেন? তখন সে ঠান্ডা মাথায় বলল- ‘ঘাবড়াবেন না। ওরা আলবদরের ছাত্র, ওরাই তো নিয়ে গেল। ওরা ডা. ফজলে রাব্বিকেও নিয়ে গেছে।’ আমি বললাম- ‘কেন নিয়ে গেল’? সে বলল- ‘বিভিন্ন জায়গায় বোম্বিং হচ্ছে, আহতদের চিকিৎসার জন্য তাদের নিয়ে গেছে।’ আমি বললাম- ‘আমার স্বামী কখন ফিরে আসবেন’? সে বলল- ‘এই তো কাজ শেষ হলেই রেখে যাবে। একটু পরেই চলে আসবে।’ আমি যতবার তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, ততবারই সে এভাবে আমাকে মিথ্যা বলেছে। রাত গভীর হলেও আমার স্বামী আসছেন না। দরজার কাছে শব্দ হলেই দৌড়ে যেতাম। মনে হতো হয়তো তিনি এসেছেন। গিয়ে দেখতাম কেউ নেই।

পরের দিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকে চারদিকে জয় বাংলার স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, সব বাড়ির ছাদে টাঙানো হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তখনই বুঝতে পারি পাকস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। আমি স্বস্তি ফিরে পাই এই ভেবে যে, যেহেতু তারা আত্মসমর্পণ করেছে তাই আমার স্বামীকে আর বেশিক্ষণ আটকিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। সকাল ১০টার দিকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বাড়িতে আসেন। তারা খুব উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে- ‘শয়তান আব্দুল মান্নান কোথায়, ও আলীম ভাইকে মেরেছে।’ আমি অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম- কী বলেন, মেরেছে আবার কী? তারা বললেন- ‘এ পর্যন্ত যাদের ধরে নিয়ে গেছে তাদের সবাইকে হত্যা করেছে ওরা।’

মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে খবর পেয়ে বাড়ির লোকেরা ডা. আলীমকে খুঁজতে বের হয়। ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর সারাদিন খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া গেল না। ১৬ ডিসেম্বর আমি নিজেও খুঁজতে বের হই। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাকে পাওয়া গেল। অমানবিক অত্যাচার করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ওরা ছিল জানোয়ার। হিংস্র জানোয়ার ছাড়া এভাবে মানুষকে কেউ হত্যা করতে পারে না। অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদেরও অমানবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে সেখানে ফেলে রেখেছিল ওরা। আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি আমার স্বামী শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীসহ জাতির সূর্য সন্তান শহীদ সব বুদ্ধিজীবীকে।

লেখক: শহীদ জায়া ও শিক্ষাবিদ

Share