নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : করোনায় আক্রান্ত রোগীদের কেউ কেউ হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, তিন দিনে ৬৬ জন রোগী হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন। এঁদের ‘পলাতক’ রোগী দেখানো হয়েছে। কিন্তু কেন কিছু রোগী এভাবে চলে যাচ্ছেন, তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন কয়েকজন রোগী বলছেন, হাসপাতালের পরিবেশ তেমন ভালো না। কেউ বলছেন, ভয়-ভীতি-আতঙ্কে রোগীরা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ মনে করেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে অনেকে আস্থা পাচ্ছেন না।
রাজধানীতে করোনার জন্য নির্ধারিত চারটি সরকারি হাসপাতাল থেকে করোনা রোগী চলে যাচ্ছেন বা পালাচ্ছেন। এ ছাড়া ঢাকাসহ পাঁচটি বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকেও রোগী চলে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সুস্থ হওয়ার আগেই তাঁরা হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন।
১৩ মে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একজন রোগী কর্তৃপক্ষের অগোচরে হাসপাতাল থেকে চলে যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই রোগীর বাড়ি দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলায়। ৭ এপ্রিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একজন রোগী চলে গিয়েছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘটনা জানার পরপরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানায়। পরে অধিদপ্তর ওই রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে আরেকটি হাসপাতালে ভর্তি করায়।
হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়া বা পালিয়ে যাওয়া রোগীরা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারেন এমন আশঙ্কা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালের বাইরে রোগী চলে যাওয়ার অর্থ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথা সরকারের উচিত সমস্যার গভীরে গিয়ে কারণ অনুসন্ধান করা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব : প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (কোভিড-১৯) একটি ছকে সারা দেশের রোগীদের হিসাব তৈরি করে। ছকের একটি ঘরে লেখা আছে, ‘হাসপাতাল থেকে পলাতক রোগীর সংখ্যা’। এই ছক তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলেছেন, করোনার জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল থেকে তাঁরা প্রতিদিন তথ্য পান। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) মাধ্যমে দেশের আট বিভাগের হাসপাতালগুলোর তথ্য পান। সর্বশেষ তিন দিনের হিসাব প্রথম আলোর হাতে এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ১১ থেকে ১৩ মে—এই তিন দিনে ঢাকার চারটি হাসপাতাল থেকে ৪৬ জন রোগী চলে গেছেন। রাজধানীর বাইরে ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকেও রোগী চলে গেছেন। তিন দিনে এই সংখ্যা ২০ জন।
কেন হাসপাতাল ছাড়ছেন : এই তিন দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী (৩২ জন) চলে গেছেন। এই হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি শুরু হয় ২ মে। এখানে আড়াই শর কম রোগী ভর্তি থাকেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাসিরউদ্দিন বলেন, এই হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী পালিয়ে যাননি। সবাই নিজ দায়িত্বে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন। তিনি আরও বলেন, হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়া রোগীরা ‘ডিওআরবি’ (ডিসচার্জ অব রিস্ক বন্ড) ফরম পূরণ করে গেছেন।
রোগী কেন হাসপাতাল ছাড়ছেন জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ফাইভ স্টার সুযোগ-সুবিধার হাসপাতালে যেসব মানুষ চিকিৎসা নিতেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে তাঁরা বাধ্য হয়ে এই হাসপাতালে আসছেন। এই হাসপাতালের পরিবেশ তাঁদের পছন্দ হচ্ছে না, তাই তাঁরা হাসপাতালে থাকছেন না।
রাজধানীতে কোভিড-১৯-এর জন্য নির্ধারিত একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন—এমন একজন রোগীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের নিয়মিত কথা হতো। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, ‘রোগটি খুবই সংক্রামক হওয়ার কারণে রোগীর কাছে কোনো ডাক্তার, নার্স আসতে চায় না। রোগী অসহায় বোধ করে, ভীত হয়ে পড়ে। এদের কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে পালালে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
কী করণীয় : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অসুস্থতার কারণে বর্তমানে মহাপরিচালকের দায়িত্বে আছেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘কিছু রোগী নিজ দায়িত্বে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান, এটা পুরোনো রেওয়াজ। তবে করোনার রোগী যাঁরা হাসপাতাল ছেড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অবশ্যই আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) থাকতে বলা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, বিষয়টি তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এ ছাড়া হাসপাতালের ভেতরের পরিবেশ উন্নত করারও চেষ্টা করা হচ্ছে।
চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরা রোগী ও বিশেষজ্ঞ বলছেন, কী কারণে করোনা রোগীরা হাসপাতাল থেকে পালাচ্ছেন বা স্বেচ্ছায় হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক বলেন, হাসপাতালের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী যাতে চলে যেতে বা পালাতে না পারেন, সে জন্য পাহারা জোরদার করতে হবে। কেউ চলে গেলে বাড়িতে তাঁর আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। রোগীর সংস্পর্শে যাঁরা আসছেন, তাঁদের শনাক্ত করে নজরদারির আওতায় আনতে হবে।