
গাজী আবু বকর : দেশ থেকে অর্থপাচার বন্ধের কারণে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর হার প্রতি মাসেই বাড়ছে। চলতি মাস মে’র প্রথম ১০ দিনে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যনেলে ৯০ কোটি ৩৪ লাখ ৯০ হাজার বা ৯০৩ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১২৩ টাকা হিসাবে যার পরিমাণ ১১ হাজার ১১২ কোটি ৯২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আর এই ১০ দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রবাসী আয় এসেছে ৯ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ডলার। আগের বছরের মে আসে প্রতিদিন গড়ে প্রবাসী আয় এসেছিল ৭ কোটি ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩৩ ডলার। রেমিট্যান্সের এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মাসে আবারও তিন বিলিয়ন ডলার অতিক্রমের রেকর্ড করতে যাচ্ছে।
আজ ১২ মে সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে প্রবাসী আয় এসেছে ২৭ কোটি ৯০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৯ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৫৩ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আর দেশে ব্যবসারত বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৬ লাখ ১০ হাজার ডলার। একক ব্যাংক হিসাবে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার বা ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার, আগস্টে আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার বা ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে আসে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার বা ২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ৮০ হাজার বা ২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, নভেম্বরে আসে ২১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার বা ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ডিসেম্বরে আসে ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার বা ২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ছিলো ঐ সময়কাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড। জানুয়ারিতে আসে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ ৩০ হাজার বা ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ফেব্রুয়ারিতে আসে ২৫২ কোটি ৭৬ লাখ ৫০ হাজার বা ২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মার্চে আসে সকল রেকর্ড ভাঙা ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার বা ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স। আর গত এপ্রিলে এসেছে ২৭৫ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার বা ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স।
প্রবাসী আয়ের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের ইতিহাসে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস ১০ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২ হাজার ৫৪৩ কোটি ৯৮ লাখ ২০ হাজার বা ২৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১২৩ টাকা হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ১২ হাজার ৯০৯ কোটি ৭৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সেই সাথে এই ১০ মাসে প্রবাসী আয়ে পর পর ৩টি রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি বিজয়ের মাস গত ডিসেম্বরে এবং অন্যটি স্বাধীনতার মাস মার্চ মাসে। এর আগে দেশের ইতিহাসে করোনাকালীন ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ১০ হাজার বা ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিলো। সেই রেকর্ড ভেঙে গত বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রবাসীরা ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার বা ২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠায়। মাত্র দু’মাসের মাথায় স্বাধীনতার মাস মার্চে প্রবাসীরা ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার বা ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। সদ্য শেষ হওয়া এপ্রিল মাসে ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসার আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। যদিও একক মাস হিসাবে গত মার্চের ইতিহাস সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের জুলাইজুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আন্দোলন দমাতে মরিয়া হয়ে ওঠে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। নির্বিচারে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এবং আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দেন প্রবাসীরা। এতে হঠাৎ কমে যায় রেমিট্যান্স প্রবাহ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর সরকারের আহ্বানে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করেন প্রবাসীরা। বাড়তে থাকে রেমিট্যান্স। প্রবাসী আয়ে দেশ গড়ে একের পর এক রেকর্ড।
উল্লেখ্য, প্রবাসী আয় হলো দেশে ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। কারণ, এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না বা কোনো দায়ও পরিশোধ করার দরকার পড়ে না। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয়। আবার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতেও ডলারের প্রয়োজন হয়। ফলে প্রবাসী আয় বাড়লে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের রিজার্ভ বা মজুত দ্রুত বৃদ্ধি পায়। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় ডলারের যে সংকট চলছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে বলে জানান কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, ডলারের দাম নিয়ে যে অস্থিরতা ছিল, তা-ও কিছুটা কমে এসেছে। ব্যাংকগুলো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ১২৩ টাকার মধ্যেই প্রবাসী আয় কিনছে।