২৪ দিনে প্রবাসী আয় এসেছে ১৬ হাজার ৪২২ কোটি টাকা

গত দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহে ধ্বস অব্যাহত রয়েছে

আনোয়ারা পারভীন : ডলার ক্রয়ের দর দামে কড়াকড়ি আরোপ অব্যাহত থাকায় গত দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহে ধ্বস অব্যাহত রয়েছে। নভেম্বরের প্রথম ২৪ দিনে প্রবাসী আয় এসেছে ১৪৯ কোটি ২৯ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে ১৬ হাজার ৪২২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। গতকাল ২৭ নভেম্বর রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল নীতির কারণে গত দুই সপ্তাহে প্রথম সপ্তাহের তুলনায় ৪৭ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলার প্রবাসী আয় কম এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশে ১ থেকে ৩ নভেম্বর প্রথম সপ্তাহে ২০ কোটি ৫৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। ৪ থেকে ১০ নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহে ৫৮ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স আসে। ১১ থেকে ১৭ নভেম্বর তৃতীয় সপ্তাহে ৩৯ কোটি ৩৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর চতুর্থ সপ্তাহে ৩০ কোটি ৫২ লাখ ৪০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স আসে। অর্থাৎ গত ১৪ দিনে পূর্ববর্তী ১০ দিনের তুলনায় ৪৭ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স কম আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নভেম্বরের ২৪ দিনে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১০ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার ডলার; কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৪ কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার ডলার; বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলার মাধ্যমে এসেছে ১৩৪ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার এবং দেশে কর্মরত বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৪৫ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। নভেম্বরের ২৪ দিনে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ও স্টেট ব্যাংক ইন্ডিয়ার মাধ্যমে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।
গত বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) অনলাইনে অনুষ্ঠিত মাত্র ৫ মিনিটের সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কিনতে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১১০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আগে যা ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে প্রবাসী আয়ে সরকারের ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকও একই পরিমাণ প্রণোদনা দিতে পারবে। ফলে প্রবাসী আয় পাঠালে উপকারভোগীরা ডলার প্রতি সর্বোচ্চ ১১৫ টাকা পাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে প্রতিদিন প্রবাসী আয় আসছে ৬ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৮৩৩ মর্কিন ডলার। আগের বছর একই সময়ে প্রতিদিন এসেছিল ৫ কোটি ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৩ ডলার। চলতি বছরের অক্টোবরে প্রতিদিন এসেছিল ৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৬ মার্কিন ডলার। অথচ চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে প্রতিদিন প্রবাসী আয় এসেছিলো ৭ কোটি ৯৪ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। মূলত ঐ সময়ে বেঁধে দেয়া দরের চেয়ে ১০ থেকে ১২ টাকা বেশী দামে রেমিট্যান্সের ডলার ক্রয়ের সুফল পাওয়া গিয়েছিলো। নভেম্বরের প্রথম ১০ দিনেই প্রবাসী আয় আসে ৮ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। তৃতীয় সপ্তাহেই আশঙ্কা করা হয়েছিলো যে, রেমিট্যান্স প্রবাহের এই ধারা পরবর্তী সপ্তাহ সমূহে অব্যাহত থাকবে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসীদের কাছ থেকে ১১৬ টাকার বেশি দামে ডলার না কেনার জন্য ব্যাংকগুলোকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলো। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেডা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের জন্য ১১৬ টাকার বেশি পরিশোধ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার একদিন পর ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে এ নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ১৪ দিনেই রেমিট্যান্স বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অদূরদর্শী নীতির প্রভাব পড়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আগের মাস অক্টোবরে প্রতিদিন প্রবাসী আয় এসেছিল ৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৬ মার্কিন ডলার। এর আগের বছরের একই সময়ে এসেছিল ৫ কোটি ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৩ মার্কিন ডলার। এ হিসাবে আগের বছর নভেম্বর ও চলতি বছরের অক্টোবর মাসের তুলনায় চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে প্রবাসী আয় বেশি এসেছে।

সেপ্টেম্বর মাসে গত ৪৪ মাসের মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় দেশে আসে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ঘোষিত ২ টাকা ৫০ পয়সা প্রণোদনার পাশাপাশি প্রবাসী আয় সংগ্রহকারী ব্যাংকগুলো আরও ২ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারবে, এমন অনুমতি দেয়। এ ছাড়াও প্রবাসী আয়ের ডলার সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরোও বেশি দামে ক্রয় করারও অনুমতি দেয়। এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় আসার পর অক্টোবর মাসে প্রবাসী আয়ে বেড়ে যায়, যা নভেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিন অব্যাহত থাকে।

গত বৃহষ্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৫১৬ কোটি ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার। আর আইএমএফের শর্তানুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে গঠিত তহবিলের অর্থ ৫ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিদ্যমান রিজার্ভ পরিস্থিতির যখন এমন নাজুক অবস্থা তখন ডলারের তীব্র সংকট সৃষ্টির কারণে আমদানির দেনা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১২ থেকে ১৪ টাকা বাড়তি দামে প্রবাসী আয় কিনছে ব্যাংকগুলো। ফলে চলতি মাসের শুরুতে অনেক ব্যাংক বাধ্য হয়ে প্রতি ডলার ১২৩ থেকে ১২৪ টাকায় প্রবাসী আয় কিনেছে। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দাম নিয়ন্ত্রণে রেমিট্যান্সের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে প্রবাসী আয়ে ব্যাংকের নিজস্ব প্রণোদনাসহ ডলারের দর কোনোভাবেই ১১৬ টাকার বেশি দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে চলতি মাসের বাকি দিনগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে শুরু করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস রেমিট্যান্স প্রবাহ ধারাবাহিকভাবে কমেছিল। দেশে তীব্র ডলার সংকটের মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয়ে বড় হোঁচট খায়। ওই মাসে গত সাড়ে ৩ বছর বা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় দেশে আসে, যা পরিমাণে ১৩৪ কোটি ডলার। এর আগে, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ১০৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স আসে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আর আগস্টে আসে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।

উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত মার্চের পর থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতে সংকট আরও প্রকট হয়। পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন-অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় তারা সভা করে ডলারের রেট নির্ধারণ করে আসছে। সর্বশেষ ব্যাংকগুলোর ঘোষণা অনুযায়ী, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনার ক্ষেত্রে ডলারের ঘোষিত দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। প্রবাসী আয়ে দুই দফায় প্রনোদনা যোগ হচ্ছে আরো ৫ টাকা। অথচ দেশের বাইরে হুন্ডি বাজারে ডলার ক্রয় হচ্ছে ১২৫ থেকে ১২৮ টাকা দরে।

Share