নয়াবার্তা ডেস্ক : ‘২৮ বছর আমার বাবা ছিল না। এতিম ছিলাম। বাবাকে দেখার বড় ইচ্ছা ছিল। আজ আমার বাবা আছে। আমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। আর কিছু চাই না।’ এক যুবক মধ্যবয়সী এক ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরে একনাগাড়ে কথাগুলো বলছিলেন। দুজনের চোখেই পানি, তবে তা আনন্দের। তাঁরা কারা, কেনই–বা এমন দৃশ্যের অবতারণা; জানতে হলে ফিরতে হবে প্রায় তিন দশক আগে।
১৯৯৩ সালে গোপালগঞ্জের বাড়ি থেকে জাহেদুল ইসলাম নামের একজন রাজশাহীতে আসেন। কাজ নেন সেখানকার একটি ওষুধ কোম্পানিতে। সে বছরই নগরের শিরোইলে বিয়ে করেন। ভাড়া বাসায় সংসার পাতেন। সন্তান আসার সুখবর পান। অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকেন। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। সন্তানের জন্মের ১০ দিন আগে স্ত্রীকে তাঁর বাবার বাড়িতে পাঠান। এর পরের দিন থেকে নিখোঁজ হন জাহেদুল।
এর মধ্যে পৃথিবীতে আসে এক নবজাতক। নাম রাখা হয় শিহাব উদ্দিন। নানা–নানির কোলেপিঠে বড় হতে থাকে শিহাব। এখন তাঁর বয়স ২৮ বছর। বিয়ে করেছেন। একটি ছেলে আছে। ছেলের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে জানতে পারেন আগে শিহাবকে নিজের জন্মনিবন্ধন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন তাঁর বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর।
অদেখা বাবার জন্য মাঝে মাঝে যে হাহাকার হতো, তা তীব্র হয়। বাবাকে খুঁজে বের করার এক ‘অসম্ভব মিশনে’ নামেন শিহাব। তথ্য বলতে শুধু ছিল, বাবার নাম জাহেদুল ইসলাম আর বাড়ি গোপালগঞ্জ। প্রথমে তিনি কাজী অফিসে যান। হতাশ হন। যে কাজী বাবা–মায়ের বিয়ে পড়িয়েছিলেন, তিনি মারা গেছেন। তাঁর এক সহকারীকে বিয়ের কাবিননামা খোঁজার টাকা দিয়ে আসেন শিহাব। দুই মাস পর জানতে পারেন, তিনিও মারা গেছেন। এবার ওই অফিসের নূর আমিন নামের একজন সহকারীকে পান। তাঁকে সব ঘটনা বলে টাকাপয়সা দিয়ে আসেন। মাসখানেক পর ওই সহকারী তাঁর বাবা-মায়ের বিয়ের কাবিননামা বের করে দেন। সেখানে দেখতে পান, বাবার নাম মো. জাহেদুল ইসলাম। ঠিকানা: গ্রাম–তিলছড়া, উপজেলা–কাশিয়ানী, জেলা–গোপালগঞ্জ।
বাবা পরিচয়ের মানুষটি আদৌ সেখানে আছেন কি না, এ চিন্তায় পড়েন শিহাব। আগে নিশ্চিত হতে চান, তাঁর বাবা জাহেদুল ইসলাম সেখানে আছেন। তিনি তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেন। গুগলে তিলছড়া বাজারের দোকানপাটের সাইনবোর্ড খুঁজতে শুরু করেন। সাইনবোর্ডে থাকা ফোন নম্বরগুলো টুকে নেন। এরপর এক এক করে সেসব নম্বরে কল করেন। অষ্টম যে নম্বরে কল করেন, রাসেল নামের সেই ব্যক্তি জাহেদুল নামের একজনকে চেনার কথা জানান।
রাসেলের সঙ্গে আলাপে শিহাব জানতে পারেন, জাহেদুল ইসলাম এখন গোপালপুর বাজারে থাকেন। এবার শিহাব গোপালপুর বাজারের সাইনবোর্ডের নম্বর খুঁজতে থাকেন। এভাবে একজনকে তিনি পান, যিনি তাঁর বাবা সম্পর্কে সব তথ্য দেন। বাবার নম্বর চাইতেই ওই ব্যক্তি জানান, জাহেদুল তাবলিগ জামাতে গেছেন। তাঁর কাছে কোনো ফোন নেই। তবে তাঁর সঙ্গী আরেকজনকে ফোন করে সবকিছু জানাবেন বলে শিহাবকে তিনি আশ্বাস দেন।
এর কয়েক দিন পর একটি অচেনা নম্বর থেকে শিহাবের কাছে কল আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একজন শিহাবের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চান। শিহাব সব বলেন। তবে ওই ব্যক্তি নিজের পরিচয় দেননি। বলেন, দুই দিন পর আবার কথা বলবেন। তবে এক দিন পরই ওই ব্যক্তি আবার কল করেন। শিহাব এবার তাঁর পরিচয়ের জন্য চেপে ধরেন। কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘তুমি যাঁকে পাওয়ার জন্য এত মানুষকে ফোন করছ, আমিই সে।’ এরপর গত কয়েক মাসে ফোনে বাবা-ছেলের কথা হয়। বাবা তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি তুলে ছেলেকে পাঠান।
শিহাব এখন ব্যবসা করেন। তাঁর গরুর খামার আছে। আর্থিকভাবে তিনি সচ্ছল। পরিবার নিয়ে সুখী জীবনের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ বাবার জন্য উসকে ওঠা হাহাকার মেটানোর উদ্যোগ নেন তিনি। বাবাকে দেখতে, একটু জড়িয়ে ধরে আদর পেতে ব্যাকুল শিহাব গত শুক্রবার রওনা দেন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর উদ্দেশে। গতকাল শনিবার কাশিয়ানী ডাকবাংলোয় সকাল সাড়ে ৬টায় বাবা-ছেলের প্রথম দেখা হয়, দীর্ঘ ২৮ বছর পর।
বাবা–ছেলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। বাবা বলেন, ‘আমি অন্যায় করেছি। যে শাস্তি দাও, আমি মাথা পেতে নেব।’ তবে সে পথে হাঁটতে চান না ছেলে। বরং বাবার স্পর্শ মরুভূমিতে বৃষ্টির শীতলতার মতো তাঁর হৃদয়ের হাহাকার মিটিয়ে দেয়। জীবনে প্রথমবারের মতো বাবার আদর পেয়ে শিহাব শিশুর মতো হয়ে যান। বাবাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার বুকের মাপ কত?’ বাবা তখন বলেন, ‘৪৬ ইঞ্চি।’ শুনে শিশুর মতো আহ্লাদিত হয়ে শিহাব বলেন, ‘আমারও ৪৬।’
কথায় কথায় জাহেদুল ইসলাম বলেন, বাড়ি ফিরে তিনি আবার বিয়ে করেছেন। তাঁর দুটি ছেলে–মেয়ে আছে। ছেলে সিঙ্গাপুরে থাকে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাবাকে নিয়ে শিহাব হোটেলে যান সকালের নাশতা করতে। খেতে বসে ছেলের মুখে খাবার তুলে দেন বাবা। বিল দেওয়ার জন্য শিহাব যখন কাউন্টারে যান, বাবা হাত না ধুয়ে সেখানে গিয়ে ছেলেকে থামান। শিহাবের ফেরার সময় ঘনিয়ে আসে। কাশিয়ানী রেলস্টেশনের সাইনবোর্ডের সামনে গিয়ে বাবার সঙ্গে সেলফি তোলেন শিহাব। ট্রেনে ওঠার আগে জোর করে বাবার পকেটে গুঁজে দেন ৫০০ টাকার কয়েকটা নোট। বাবা–ছেলের সাক্ষাতের আবেগঘন মুহূর্তগুলোর সাক্ষী এই প্রতিবেদক। ছেলে ট্রেনে ওঠেন। বাবা চোখের জলে হাত নেড়ে বিদায় জানান। ট্রেন চলতে শুরু করে। পেছনে থেকে যায় ২৮ বছর আগে জাহেদুল কাউকে কিছু না বলে কেন রাজশাহী ছেড়েছিলেন, উত্তর না জানানো সেই প্রশ্ন।