নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের প্রভাব এখনো দৃশ্যমান হয়নি। নতুন রোগী, পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার এবং মৃত্যু—সবই বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে ৯ দিন ধরে দেশে সংক্রমণের ভয়ংকর চিত্র দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি গত এক বছরেও দেখা যায়নি। প্রায় প্রতিদিনই রোগী শনাক্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুতে নতুন রেকর্ড হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ বা লকডাউনের মতো পদক্ষেপের প্রভাব দেখা যায় সাধারণত এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার সপ্তাহ দুয়েক পর থেকে। সে হিসাবে আরও কিছুদিন নতুন রোগী বাড়বে। আরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ মৃত্যু বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে। আগামী সপ্তাহের শেষ দিকে লকডাউনের প্রভাব দৃশ্যমান হতে পারে। তবে এখন গ্রামেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে বিধিনিষেধ সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না। ফলে এবারের বিধিনিষেধ বা লকডাউন কতটা ফল বয়ে আনবে, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে।
প্রায় দেড় বছর ধরে চলমান করোনা মহামারিতে গতকালই প্রথম এক দিনে ১০ হাজারের বেশি রোগী শনাক্তের খবর এল। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল আটটা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল আটটা) নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৫২৫ জন। একই সময়ে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং মারা গেছেন ১৬৩ জন। বিশ্বে যেসব দেশে এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি, তার একটি বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে, এমন শীর্ষ ১২টি দেশের একটি বাংলাদেশ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, সংক্রমণের আরেকটি পিকের (শীর্ষ চূড়া) দিকে যাচ্ছে দেশ। এখন সংক্রমণ শনাক্তের হার অনেক বেশি, যা আশঙ্কাজনক। আরও কিছুদিন নতুন রোগী বাড়বে। ১০ জুলাইয়ের পরে সংক্রমণ কিছুটা কমতে শুরু করবে বলে তাঁরা ধারণা করছেন। তবে মৃত্যু জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাড়তে থাকবে। ১৭-১৮ জুলাই নাগাদ একটি স্থিতিশীল অবস্থা দাঁড়াতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে বিধিনিষেধ কতটুকু কার্যকর বা মানা হচ্ছে তার ওপর। এসব ঢিলেঢালা হয়ে গেলে সংক্রমণ কমবে না।
গত জুনের মাঝামাঝি থেকে প্রায় সারা দেশেই সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ১ জুলাই থেকে সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। বিধিনিষেধ চলবে ১৪ জুলাই পর্যন্ত। বিধিনিষিধের এক সপ্তাহের মাথায় এসে রাস্তায় মানুষের চলাচল বেড়েছে। সামনে ঈদুল আজহাকেন্দ্রিক যাতায়াত আরও বাড়তে পারে।
সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২৮ জুন দেশে প্রথমবারের মতো এক দিনে রোগী শনাক্তের সংখ্যা আট হাজার ছাড়ায়। এরপর থেকে গত ৯ দিনে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। এই সময়ে ৭৮ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ১ হাজার ২২০ জন। অর্থাৎ এই সময়ে প্রতিদিন গড়ে ৮ হাজার ৬৬৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, আর প্রতিদিন গড়ে ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এক বছরে কখনোই সংক্রমণ পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতে দেখা যায়নি।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এখন যাঁরা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন এবং যাঁদের মৃত্যু হচ্ছে, তাঁরা মূলত কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের আগেই সংক্রমিত হয়েছেন বলে ধরা যায়। আর সপ্তাহখানেক পর বোঝা যাবে, লকডাউনের সময় সংক্রমণের গতি কেমন ছিল। তাঁরা বলছেন, ঢাকার বাইরে চিকিৎসা সুবিধা সীমিত ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা কম। ফলে সামনের দিনে দৈনিক মৃত্যু আরও বেড়ে যেতে পারে। সাধারণত শনাক্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে কেউ সুস্থ হয়ে যান অথবা তাঁর মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গতকাল পর্যন্ত দেশে ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৬ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ জন, আর মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ৩৯২ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহ ধরে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ২৫ শতাংশের ওপরে। তবে গতকাল সেটি ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এই হার থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ থেকে এখন অনেক দূরে। কোনো দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বুঝতে কয়েকটি মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেগুলোর একটি হলো রোগী শনাক্তের হার। টানা অন্তত দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা হয়।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, গ্রামে গ্রামে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (সামাজিক সংক্রমণ) হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সবাইকে মাস্ক পরার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, সরকারের উচিত ১০০ কোটি টাকা খরচ করে মাস্ক কেনা এবং সবাইকে বিশেষত গ্রামে তা বিনা মূল্যে বিতরণ করা।