আজিমপুর মাতৃসদনে ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা আত্মসাৎ

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : আজিমপুর মাতৃসদনে বাজারমূল্য থেকে বেশি মূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয়ের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাতের মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের তদন্তে অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক দুই মহাপরিচালকের (ডিজি) জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। ফলে সাবেক ডিজি ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ারকে একটি এবং সাবেক ডিজি মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেনকে দুটি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি করার সুপারিশসহ আদালতে চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন চেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। কমিশনের অনুমোদন পেলেই সাবেক দুই ডিজিকে অন্তর্ভুক্ত করে ২৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হবে।

দুদকের তথ্যমতে, অভিযোগে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কেনাকাটার নামে ৫ কোটি ২১ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে ২৫ জনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করে দুদক। প্রতিটি মামলায় প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক ইসরাত জাহানকে আসামি করা হয়। এর পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান দুদকের উপপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিক। তিনি তদন্ত শুরুর পরই একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর ২৫ আসামির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে (এসবি) চিঠি দেন। তদন্ত পর্যায়ে তিনি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। অভিযোগের বিষয়ে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সাবেক ডিজি মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেনকে এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক মহাপরিচালক ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদে তারা কেনাকাটায় অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করে লিখিত বক্তব্য দেন। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তকাজ শেষ করে সম্প্রতি কমিশনে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন ও ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ারসহ ২৭ জনকে আসামি করার সুপারিশ করেন।

দুদকের কর্মকর্তারা বলেন, আজিমপুর মাতৃসদনে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এসব পণ্য ক্রয়ে দরপত্র আহ্বান, দরপত্র মূল্যায়ন ও বাজারদর যাচাই কমিটি রয়েছে। এসব দরপত্রের সর্বনিম্ন দরদাতার দর অনুমোদন না করে মনগড়া ও ভিত্তিহীন দরকে বিবেচনা করেন এবং স্ট্যান্ডার্ড রেটের বেশি দরে মালামাল ক্রয়ের ফাইল প্রস্তুত করেন। বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে পণ্য কেনার বিষয়টি জানার পরও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন ও ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ার এসব ফাইল না আটকে ক্রয়ের অনুমোদন দেন। তারা আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে বেশি দামে কেনার সুযোগ করে দেন। দুদকের তদন্তে বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় সাবেক দুই ডিজিকে চার্জশিটে আসামি করার সুপারিশ করা হয়।

তদন্তে প্রতিবেদনে বলা হয়, তারা প্রতারণা ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দরপত্রের মাধ্যমে মেডিসিন ও সার্জিক্যাল আইটেম ক্রয়ের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা লঙ্ঘন করেন। এমনকি ওষুধ ও সার্জিক্যাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়নি এবং বিদ্যমান বাজারদর অনুসরণ করা হয়নি। বরং বাজার যাচাই কমিটির প্রণীত মনগড়া ও ভিত্তিহীন দরকে বিবেচনায় নিয়ে ঠিকাদারকে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ দেওয়া হয়। এভাবে তারা চার অর্থবছরে দরপত্রের সর্বনিম্ন দরদাতার দর অনুমোদন না করে মনগড়া ও ভিত্তিহীন দরকে বিবেচনা করেন এবং স্ট্যান্ডার্ড রেটের বেশি দরে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ঠিকাদারদের অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করেন। দুদকের তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইসরাত জাহানের সঙ্গে পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দুই ডিজিসহ অন্যরা পরস্পর যোগসাজশ করে বাজারমূল্য থেকে বেশি মূল্যে চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়। এ কারণে সাবেক দুই ডিজিসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন চেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

দুদকের জনসংযোগ শাখা জানায়, আজিমপুর মাতৃসদনে বাজারমূল্য থেকে বেশি মূল্যে চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের অভিযোগে চারটি মামলা করে দুদক। দুদকের তদন্তে ১৬ নম্বর মামলায় ১১ আসামির বিরুদ্ধে নির্ধারিত মূল্য থেকে বেশি দামে ওষুধ, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ও প্যাথলজিসামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে ১ কোটি ২৮ লাখ ৬৩ হাজার ২৪১ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ায় চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দেওয়া হয়।

অপর তিনটি মামলার মধ্যে ১৭ নম্বর মামলায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে পণ্য ক্রয়ের নামে সরকারের ১ কোটি ৪০ লাখ ৮৭ হাজার ৩৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। মামলায় প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইসরাত জাহান ও তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়। মামলার তদন্তকালে দেখা গেছে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ও বাজারদর পর্যালোচনা কমিটি অন্যদের সঙ্গে যোগসাজশ করে নির্ধারিত মূল্য থেকে বেশি মূল্যে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ফাইল প্রস্তুত করেন। পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তৎকালীন ডিজি ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ার ওই ফাইল না আটকে বেশি দামে পণ্য ক্রয়ের অনুমোদন দেন। তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে বেশি দামে ওষুধ, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ও প্যাথলজিসামগ্রী ক্রয়ের সুযোগ করে দেন। এ মামলায় সাবেক ডিজি ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। এখন সেটি কমিশনে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে মালামাল ক্রয়ের নামে সরকারের ১ কোটি ১২ লাখ ১৫ হাজার ৩০৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে একটি মামলা (মামলা নং-১৮) করা হয়। মামলায় প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইসরাত জাহান ও তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ মোট ১১ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে পণ্য ক্রয়ের নামে সরকারের ১ কোটি ৩৮ লাখ ২৮ হাজার ৯৫৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে একটি মামলা (মামলা নং-১৯) করা হয়। এই মামলায় প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইসরাত জাহান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ মোট ১৩ জনকে আসামি করা হয়। দুদকের তদন্তকালে দেখা গেছে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ও বাজারদর পর্যালোচনা কমিটি নির্ধারিত মূল্য থেকে বেশি মূল্যে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ফাইল প্রস্তুত করে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তৎকালীন ডিজি ওয়াহিদ হোসেন ওই ফাইল না আটকে বেশি দামে পণ্য ক্রয়ের অনুমোদন দেন। তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে বেশি দামে ওষুধ, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ও প্যাথলজিসামগ্রী ক্রয়ের সুযোগ দেন। সরকারি অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় সাবেক ডিজি ওয়াহিদ হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। কমিশন অনুমোদন পেলেই সাবেক ডিজিসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।

জানা গেছে, অভিযোগে আজিমপুর মাতৃসদনে কেনাকাটার নামে ৫ কোটি ২১ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে ২৫ জনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করে দুদক। প্রতিটি মামলায় প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক ইসরাত জাহানকে আসামি করা হয়। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মনার্ক এস্টাব্লিশমেন্টের মালিক মো. ফাতে নূর ইসলাম, মেসার্স নাফিসা বিজনেস কর্নারের মালিক শেখ ইদ্রিস উদ্দিন (চঞ্চল), সান্ত¡না ট্রেডার্সের মালিক নিজামুর রহমান চৌধুরী, পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সাবেক অধ্যক্ষ ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. পারভীন হক চৌধুরী, মাতৃসদনের সাবেক সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. মাহফুজা খাতুন, সাবেক সহকারী কো-অর্ডিনেটর (ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ) ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. চিন্ময় কান্তি দাস, সাবেক মেডিক্যাল অফিসার ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. সাইফুল ইসলাম, পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. জেবুন্নেসা হোসেন, মেডিক্যাল অফিসার ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. রওশন জাহান, সিনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) ও বাজারদর যাচাই কমিটির সভাপতি ডা. রওশন হোসনে জাহান, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও বাজারদর যাচাই কমিটির সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম, মেডিক্যাল অফিসার (শিশু) ও বাজারদর যাচাই কমিটির সদস্য ডা. বেগম মাহফুজা দিলারা আকতার, মাতৃসদনের মেডিক্যাল অফিসার ও বাজারদর যাচাই কমিটি সদস্য ডা. নাজরিনা বেগম, মাতৃসদনের সাবেক সহকারী কো-অর্ডিনেটর (ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ) ও পরিবার-পরিকল্পনার অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. মো. লুৎফুল কবীর খান, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক হালিমা খাতুন, মাতৃসদনের বিভাগীয় প্রধান (শিশু) ও বাজারদর যাচাই কমিটির সদস্য মো. আমীর হোসাইন, সাবেক সমাজসেবা কর্মকর্তা ও বাজারদর যাচাই কমিটির সদস্য মোছা. রইছা খাতুন ও সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান। পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. কাজী গোলাম আহসান, সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছের উদ্দিন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (শিশু) ডা. নাদিরা আফরোজ, পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. নাছের উদ্দিন, মেডিক্যাল অফিসার আলেয়া ফেরদৌসি ও সমাজসেবা কর্মকর্তা বিলকিস আক্তার।

Share