যশোর শিক্ষাবোর্ডে দুর্নীতি : আয়কর-ভ্যাটের চেক জালিয়াতি করে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ

নয়াবার্তা প্রতিনিধি : যশোর শিক্ষাবোর্ডে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সরকারি কোষাগারে জমার জন্য আয়কর ও ভ্যাট বাবদ ১০ হাজার ছত্রিশ টাকার ৯টি চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেকগুলো জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং এবং শাহী লাল স্টোর নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে এই বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংক শিক্ষাবোর্ড শাখার এই চেকগুলো ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার মাধ্যমে পরিশোধিত হয়েছে। সম্প্রতি বোর্ডের হিসাব ও নিরীক্ষা দপ্তরের উপ পরিচালক ইমদাদুল হক ও অডিট অফিসার আব্দুস সালাম আজাদ অভ্যন্তরীণ অডিট করার সময় এই চেক জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পারেন। পরবর্তীতে সোনালী ব্যাংক শিক্ষা বোর্ড শাখাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ খবর নেয়ার পর তারা চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা আতœসাতের বিষয়টি নিশ্চিত হন।

বৃহস্পতিবার বিকেলে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাতের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এরপর সাংবাদিকরা এ বিষয়ে খোঁজ নিতে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানের দপ্তরে যান। ওই সময় সেখানে উপস্থিত যশোর শিক্ষাবোর্ড এমপ্লইজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান বলেন বোর্ডের চেয়ারম্যান একজন দুর্নীতিবাজ।

তার বিরুদ্ধে অনিয়ম আর অর্থআতœসাতের অভিযোগ এটাই প্রথম নয়। তারই ধারাবাহিকতায় এই চেক জালিয়াতির ঘটনা। তবে এই শ্রমিক নেতার অভিযোগের বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোল্লা আমীর হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেক প্রিন্টিং করা। সেখানে হাতে লেখার সুযোগ নেই। ধারণা করা হচ্ছে জালিয়াতি করে ভুয়া চেকের মাধ্যমে এসব টাকা আতœসাৎ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা থানায় জিডি করেছি। গঠন করা হয়েছে ৫ সদস্যর তদন্ত কমিটি। যার প্রধান কলেজ পরিদর্শক কেএম রব্বানি। কমিটির রিপোর্ট আসার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।


্এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক শিক্ষাবোর্ড শাখার ব্যবস্থাপক এসএম শাহিদুর রেজা জানান, ভেনার্স প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ঢাকার ফকিরাপুল ও যশোরের রাজারহাট নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় ইস্যুকৃত ৭টি চেক ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ক্লিয়ারিং চেকের মাধ্যমে আর শাহী লাল স্টোর, হাইকোর্ট মোড়, যশোরের নামে ইস্যুকৃত ২টি চেক ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ক্লিয়ারিং চেকের ম্যাধ্যমে এসব টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। তবে বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মোল্লা আমির হোসেন চেক জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমান টাকা আতœসাতের বিষয়টি স্বীকার করলেও কিভাবে এই বিপুল পরিমান অংকের চেক বোর্ড থেকে ইস্যু হয়েছে সে বিষয়টি সম্পর্কে পরিস্কার কোন উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ঘটনাটি রহস্যাবৃত।

তবে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ব্যবস্থাপক রিয়াদ হাসান জানিয়েছেন, আমার ব্যাংকের একাউন্ট হোল্ডার জনৈক শরিফুল ইসলামের হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জমা হওয়া শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিব স্বাক্ষরিত ৭টি চেক অরিজিনাল। আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চেক গুলি ক্লিয়ারিং করার জন্য প্রপার চ্যানেলে ইস্যুকারী সোনালী ব্যাংক যশোর শিক্ষা বোর্ড শাখায় প্রেরণ করি। সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যথা নিয়মে চেকগুলি ক্লিয়ারিং করে ক্যাশ করে গ্রাহকের একাউন্টে ক্যাশ প্রেরণ করেছে। গ্রাহক উক্ত হিসাবের সমুদয় টাকা ইতিমধ্যে উত্তোলন করে নিয়েছে। এই চেক জালিয়াতির সঙ্গে আমাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। সোনালী ব্যাংকের ক্লিয়ারেন্সর ভিত্তিতে গ্রাহককে চেকের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর সমন্বিত কার্যালয়ের (দুদক) উপ-পরিচালক মো: নাজমুচ্ছায়াদাত জানান, বিষয়টি আমরা শুনেছি, রোববার সব নথি তলব করা হবে। সরকারের টাকা আতœসাতের সাথে যারাই জড়িত হোক না কেন কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের হিসাব ও নিরীক্ষা শাখার উপ পরিচালক ইমদাদুল হক জানান, যশোর শিক্ষাবোর্ডের হিসাব ও নিরীক্ষা শাখা এবং অডিট সেকশন যৌথ ভাবে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের আয় ব্যয় বোর্ডের সকল ব্যাংক একাউন্টের স্টেটমেন্টের সাথে মিলকরণ করতে গিয়ে দেখতে পান বোর্ডের ব্যয় একাউন্ট এসটিডি-২৩২৩২৪০০০০০২৪ হিসাবের ৯টি চেক পরিশোধিত হয়েছে। যা বোর্ডে সংরক্ষিত মুড়ি বইয়ের চেকে উল্লেখিত টাকার পরিমাণের সাথে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরিশোধিত টাকার মিল নেই। এ ধরণের অমিল ধরা পড়ায় হিসাব প্রদান শাখার হিসাব রেজিস্ট্রারের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়। বোর্ডে সংরক্ষিত মুড়ি বইয়ের ৯টি চেকের তারিখ অনুযায়ী হিসাব শাখায় ব্যয় রেজিস্ট্রারের ব্যয় বিবরণীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য একাউন্ট পে চেকগুলো ইস্যু করা হয়। ইস্যুকৃত চেকগুলোর বিপরীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ ১০ হাজার ৩৬ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু ওই চেক গুলোর বিপরীতে কোন অর্থই সরকারী কোষাগারে জমা হয়নি। শিক্ষাবোর্ডের ইস্যুকৃত ৯টি চেক জালিয়াতি করে দুটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করেছে। এরমধ্যে ২০২০ সালের ৮ই জুলাই আয়কর বাবদ ০৫১৬৫২৩ নম্বর চেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা ইস্যু করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ওই চেক জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৩০ জুলাই ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করেছেন। একই ভাবে ২০২০ সালের ১২ আগস্ট ভ্যাট বাবদ ০৫১৬৬৮২ নম্বর চেকে ভ্যাট আইটি বাবদ এক হাজার ২০৭ টাকার ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ২৮ সেপ্টেম্বর ১৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং। ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট আয়কর বাবদ০৫১৬৭৮৭ নম্বর চেকে ভ্যাট আইটি বাবদ ৬০০ টাকা চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে শাহী লাল স্টোর নামে একটি ফটোস্ট্যাটের প্রতিষ্ঠান ২৬ অক্টোবর/২০২০ ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর ০৫১৭২৪৩ নম্বর চেকে আয়কর বাবদ ৬৭৮ টাকার চেক ইস্যু করে বোর্ড। এই চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে শাহী লাল স্টোর নামের ফটোস্ট্যাটের দোকানের মালিক গত ১৭ ডিসেম্বর ২৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে শাহী লাল স্টোর। এই শাহী লাল স্টোরের নামে ইস্যুকৃত চেক দুটি গ্রাহক ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার অনুকুলে গ্রাহক তার হিসাবে জমা দেন। একই বছরের ১৯ নভেম্বর ভ্যাট বাবদ ১৯ নভেম্বর ০৫১৭২৫৪ নম্বর চেকে ৬০০ টাকা ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ২৬ নভেম্বর/২০ তারিখে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং নামের প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জনৈক শরিফুল ইসলাম। ২০২১ সালের ৬ই মে ভ্যাট বাবদ ৯৯৬ টাকার ০৫১৮৫৫৫ নম্বর চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ২৫ মে/২১ তারিখে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার গ্রাহক শরিফুল ইসলামের হিসাব নম্বরের মাধ্যমে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং। একই বছরের ২৯ জুন ভ্যাট বাবদ০৫১৮৭৫৫ নম্বর চেকের মাধ্যমে এক হাজার ৭২৫ টাকা ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ১৪ সেপ্টেম্বর/২১ তারিখে ৪২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং। একই বছরের ৩০ জুন ভ্যাট বাবদ এক হাজার ৮০ টাকার ০৫১৮৭৭৫ নম্বর চেক ইস্যু করে বোর্ড। ওই চেক জালিয়াতি করে ১১ আগস্ট/২১ ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং। একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর আয়কর বাবদ বোর্ড ৬৫০ টাকার ০৫১৯০০৮ নম্বর চেক ইস্যু করেছে। এই চেক জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ৩০ সেপ্টেম্বর/২১ তারিখে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে। ভ্যাট ও আয়কর বাবদ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ১০ হাজার ৩৬ টাকা বাবদ ৯টি চেক ইস্যু করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ওই চেকগুলো জালিয়াতি করে দুটি ব্যাংকের মাধ্যমে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে। ব্যাংক থেকে পরিশোধিত চেক/অর্থের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান দুটি বোর্ডে কোন মালামাল বা সেবা সরবরাহ করেনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়মানুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠান বোর্ডে মালামাল সরবরাহের লক্ষ্যে বোর্ডের সচিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর কার্যাদেশে উল্লেখিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্টোরে মালামাল সরবরাহ করে বোর্ডের সচিবের কাছে মালামালের চালান ও বিল ভাউচার দাখিল করবেন। তারপর বোর্ডের সচিব মালামাল বুঝে নেওয়ার জন্য চালান ও বিলের উপর স্টোর কিপারকে মার্ক করে স্টোরে প্রেরণ করবেন। স্টোর কিপার ওই চালান এবং বিল ভাউচার সচিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত স্মারকে কার্যাদেশ অনুযায়ী মালামাল বুঝে নিয়ে বিল প্রদানের জন্য রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বিল ভাউচার হিসাব প্রদান শাখায় প্রেরণ করবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হিসাব প্রদান শাখার কার্যাদেশের মাধ্যমে বিল প্রদান নথি নিরীক্ষা করে দেখা যায় ব্যাংক হতে পরিশোধিত অর্থের বিপরীতে কোন বিল ভাউচার নথিতে উপস্থাপন করা হয়নি। অথচ জালিয়াতি চক্র অন্য বিল হতে ভ্যাট ও আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার লক্ষ্যে ইস্যু করা চেকগুলোর মুড়ির নম্বরের এবং তারিখের মিল রেখে চেক জালিয়াতি করে বোর্ড তহবিলের টাকা আত্মসাৎ করেছে।

Share