নয়াবার্তা ডেস্ক : দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকাল ৪টায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নতুন প্রধান বিচারপতিকে শপথবাক্য পাঠ করান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গভবনের দরবার হলে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। পরে নিয়ম অনুযায়ী শপথনামায় সই করেন নতুন প্রধান বিচারপতি।
শুক্রবার শপথ অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ আগে দরবার হলে প্রবেশ করেন নতুন প্রধান বিচারপতি। তার কিছুক্ষণ পর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একসঙ্গে সেখানে প্রবেশ করেন। রাষ্ট্রপতি শপথ অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়ালে নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বৃহস্পতিবার সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন। এরপরই সন্ধ্যায় আইন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে।
দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি ছিলেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। প্রায় চার বছর দায়িত্ব পালন শেষে আজ শুক্রবার তিনি অবসরে গেলেন। এখন প্রধান বিচারপতি পদে তার স্থলাভিষিক্ত হলেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ১৯৫৬ সালে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার রমানাথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ১৯৭২ সালে তিনি খোকসা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর সাতক্ষীরা আচার্য্য প্রফুল্ল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঐ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯৭৬ সালে স্নাতক পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৭৮ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তার পর তিনি ধানমন্ডি ‘ল’ কলেজ থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিচারাঙ্গনে অনিয়ম-দুর্নীতি, সমস্যা যা-ই থাকুক, তা নিরসনে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।শপথ নেবার পর গণমাধ্যমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা জানান। প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারাঙ্গনের যারা আছেন, তাদের পাশাপাশি দেশবাসীরও সহযোগিতা প্রয়োজন। সবার সহযোগিতা চাই। তাহলে কিছুটা হলেও বিচার বিভাগকে এগিয়ে নেওয়া যাবে।
আইনজ্ঞদের মতে, নতুন প্রধান বিচারপতি ২১ মাস দায়িত্ব পালন করবেন। এ জন্য এখনই তাকে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে বিচার বিভাগকে এগিয়ে নিতে হবে।
দেশের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিশিষ্টজনের মতে, বিচার বিভাগে স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিতে নতুন প্রধান বিচারপতির সামনে পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন প্রায় ৪০ লাখ মামলার জট কমিয়ে আনা, আপিল বিভাগে বিচারক স্বল্পতা নিরসন, বিচারাঙ্গনের অনিয়ম রোধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করা এবং করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালত ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা বজায় রেখে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রধান বিচারপতিকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তাহলেই বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা অটুট থাকবে। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতি নিয়োগকে ইস্যু করে ছুটিতে যাওয়া আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর বিষয়টিও সাংবিধানিকভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। যাতে এ নিয়ে বিচার বিভাগকে কেউ অস্থিতিশীল করার সুযোগ না পায়।
চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে নতুন প্রধান বিচারপতিকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি আইনজীবী ও বিচারক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম করেছেন। এখন তিনি সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হলেন। আশা করছি, তার বলিষ্ঠ ভূমিকা বিচারাঙ্গনকে দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখবে। কীভাবে বিচারাঙ্গনকে দুর্নীতিমুক্ত করা যায়- এমন প্রশ্নে ড. কামাল হোসেন বলেন, প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে একান্তে আলাপ করতে পারেন, তাদের কাছ থেকে মতামত নিতে পারেন বা আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকও করতে পারেন। সেখান থেকে নিশ্চিয়ই ভালো মতামত আসবে। সেগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিচারাঙ্গনকে কলুষমুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতিকে মামলাজট কমাতে যোগ্যতাসম্পন্ন ও রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে বিচারক নিয়োগের পদক্ষেপ নিতে হবে। দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারকরা তৎপর হলে বিচার বিভাগে পরিবর্তন আসবে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, মামলাজট, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য ধারণার কারণে বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা বাড়ছে, সেটা দাবি করা অযৌক্তিক হবে। আস্থা বৃদ্ধির সফল পদক্ষেপ ইদানীংকালে প্রধান বিচারপতিরা নিতে পেরেছেন- এমন দাবি করাও দুস্কর। এরপরও প্রত্যাশা এটাই যে, নতুন প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করতে সফল পদক্ষেপ নিতে সমর্থ হবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সংবিধানকে সমুন্নত রেখে প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব পালন করবেন। এ ক্ষেত্রে মামলাজট, বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা অর্জন এবং বিচারাঙ্গন থেকে দুর্নীতিমুক্ত করতে ইস্পাত দৃঢ় ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা করছি। এগুলো নতুন বিচারপতির জন্য চ্যালেঞ্জ।
এদিকে, যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচার ত্বরান্বিত করতে নতুন প্রধান বিচারপতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, নতুন প্রধান বিচারপতি ৩০ লাখ শহীদ পরিবার এবং বিচারপ্রত্যাশী গোটা জাতির প্রত্যাশা পূরণের জন্য অবিলম্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনরুজ্জীবিত করবেন। এর সঙ্গে আপিল বিভাগের বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিরও উদ্যোগ নেবেন। এ ক্ষেত্রে বিচারকদের সংখ্যা যদি কম হয়, তাহলে আপিল বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে তিনি বিশেষভাবে উদ্যোগী হবেন।