নয়াবার্তা প্রতিবেদক : সরকারবিরোধী চলমান যুগপৎ আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে শিগগির যৌথ রূপরেখা ঘোষণা করবে বিএনপি। বিএনপির ১০ দফা দাবি ও ২৭ দফা রূপরেখার সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফার সমন্বয়ে নতুন এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে যৌথ ঘোষণাপত্রের ৭ দফা একটা খসড়াও প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, যৌথ ঘোষণাপত্র সাত বা আট দফার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। শরিক জোট ও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে শিগগির তা চূড়ান্ত করা হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলে চলতি মাসের শেষদিকে কিংবা মার্চ মাসের প্রথম দিকে আন্দোলনের যৌথ রূপরেখা ঘোষণা করা হতে পারে। এ রূপরেখাকে ভিত্তি করেই সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলন পরিচালিত হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও যুগপৎ আন্দোলন পরিচালনায় গঠিত লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটের ঘোষিত দাবি এবং রূপরেখার সমন্বয়ে নতুন যৌথ ঘোষণা তৈরি হচ্ছে, যাতে সবাইকে নিয়ে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। মানুষ প্রস্তুত হয়ে গেছে। আন্দোলনের সফলতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে দশ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। এর পর রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কারে ১৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করে দলটি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’-এর আলোকে ২৭ দফার ওই রূপরেখা প্রস্তুত করা হয় বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কী কী করতে চায়, ওই রূপরেখার মধ্যে সেটা স্পষ্ট করেছে বিএনপি। এদিকে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণার দিন জামায়াতে ইসলামীও ১০ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশব্যাপী যুগপৎ গণআন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। এ ছাড়া বিএনপির ঘোষিত ১০ দফার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ১২ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের ১৪ দফা ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ।
ভিন্ন ভিন্ন এসব দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। প্রথম কর্মসূচি হিসেবে ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার বাইরে জেলা ও মহানগরে এবং ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে বিলুপ্ত ২০ দলীয় জোটের শরিকরা ‘১২ দলীয় জোট’ ও ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ নামে পৃথক দুটি জোট গঠন করে প্রথম থেকেই যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। যুগপৎ আন্দোলন ঘোষণার আগে গত ৯ ডিসেম্বর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে জোট বিলুপ্ত ঘোষণা করে বিএনপি। এ ছাড়া এলডিপি প্রথম কর্মসূচি থেকে এবং গণফোরাম (মন্টু) দ্বিতীয় কর্মসূচি থেকে পৃথকভাবে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। তবে পরবর্তী সময়ে গণফোরাম (মন্টু) ও বাবুল সরদার চাখারীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) যৌথভাবে কর্মসূচি পালন করছে।
যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত জোটের একজন নেতা বলেন, ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শভিত্তিক পৃথক দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন পরিচালিত হওয়ায় শরিকদের মধ্যে ‘প্রকৃত’ ঐক্য নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এতে আন্দোলনেও সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। তা ছাড়া বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও আন্দোলনে শরিকদের ঐক্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। বিষয়টি অনুধাবন করে আন্দোলনের ‘অভিন্ন দফা’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় বিএনপি।
তিনি দাবি করেন, অভিন্ন দফার ভিত্তিতে আন্দোলন শুরু হলে দেশবাসীর কাছে এ বার্তা যাবে যে, দেশের স্বার্থে মতপার্থক্য ভুলে সরকার হটাতে শরিকরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তখন দেশবাসীর মধ্যেও সাহসের সঞ্চার হবে, তারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে।
জানা যায়, যুগপৎ আন্দোলনের অভিন্ন দফা প্রণয়নে গত মাসের প্রথমদিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং গণতন্ত্র মঞ্চের জোনায়েদ সাকি ও হাসনাত কাইয়ুমকে নিয়ে একটি ড্রাফট কমিটি গঠন করা হয়। তারা একাধিক বৈঠক করে অভিন্ন রূপরেখার ৭ দফা খসড়া প্রণয়ন করেন। আজ বুধবার অনুষ্ঠেয় গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠকে যৌথ ঘোষণাপত্রের এ খসড়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। সেখানে খসড়া নিয়ে ঐকমত্য হলে শিগগির ড্রাফট কমিটির ফের বৈঠক হবে। তারপর যুগপৎ আন্দোলনের বাকি শরিকদের মতামতের ভিত্তিতে বিএনপির নীতিনির্ধারণী কমিটির বৈঠকে যৌথ ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ ও বিএনপির মধ্যে একটা কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম চূড়ান্ত করার জন্য একটা ড্রাফট কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটির পক্ষ থেকে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই ড্রাফটটা গণতন্ত্র মঞ্চ ও বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায়ে গ্রহণ করার ব্যাপার আছে। গৃহীত হলে পরে আন্দোলনকারী অন্যসব শক্তির সঙ্গে মিলে আমরা এই মাসের মধ্যেই যৌথ ঘোষণা দিতে পারব বলে আশা করছি। এটা যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। অভিন্ন দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন নবতর পর্যায়ে উপনীত হবে বলে দাবি করেন তিনি।
খসড়া রূপরেখার প্রথম দফায় বলা হয়েছে, বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ/নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। যে সরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। এই নির্বাচন কমিশন অগণতান্ত্রিক আরপিও সংশোধন, প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পরিবর্তন সাধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটের সুস্থ ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার বাতিল করবে।
খসড়ার দ্বিতীয় দফায় উল্লিখিত দাবির মধ্যে রয়েছে—রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক জবাবদিহিহীন স্বেচ্ছাচারী কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, ন্যায়পাল ও সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠনের আইন প্রণয়ন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সংসদের দুই কক্ষের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থাভোট ও বাজেট পাস সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া মতামত প্রদান ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
এই দফায় আরও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাসহ বিকেন্দ্রীকৃত শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা হবে। পরপর দুবার প্রধানমন্ত্রী পদে কেউ আসীন হবে না। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করতে নিম্ন আদালতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি উচ্চ আদালতের ওপর ন্যস্ত করা এবং উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং রাষ্ট্রীয় হিসাব ও আর্থিক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহের আইনি সংস্কার করা হবে।
তৃতীয় দফায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের অংশ হিসেবে সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর সাজা বাতিল, সব হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও সব রাজনৈতিক কারাবন্দির অনতিবিলম্বে মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব নির্যাতনমূলক আইন বাতিলের দাবি তুলে ধরে গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে এর আগে সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুনের যথাযথ তদন্ত এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
চতুর্থ দফায় বিগত বছরগুলোতে বিশেষ করে ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, শেয়ার মার্কেট, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি ও এর দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করতে শক্তিশালী কমিশন গঠনসহ এসব অপরাধে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশে বিনিয়োগ কর্মকাণ্ডে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিমালা তৈরি করতে হবে। কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। পাটকল-চিনিকলসহ বন্ধ কলকারখানা চালু, শ্রমিক ও শ্রমজীবীদের বাঁচার মতো মর্যাদাপূর্ণ মজুরি ঘোষণা ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার থাকবে।
ষষ্ঠ দফায় নারীর অধিকার এবং সব ধর্ম, জাতি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগরিক মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করার নীতি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
খসড়া রূপরেখার সপ্তম দফায় বলা হয়েছে, জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সমতা, ন্যায্যতা, পারস্পরিক স্বার্থের স্বীকৃতি এবং স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।