খুনের মামলার তদন্তে ‘সুপারম্যানের’ ভূমিকায় পুলিশ

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : মরদেহ রাত দেড়টায় উদ্ধারের পর সুরতহাল করেছে পুলিশ। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ পাঠানো হয়েছে হাসপাতালে। এরপর মামলা, আসামি গ্রেপ্তার, ঘটনাস্থল পরিদর্শন, মানচিত্র তৈরি, সাক্ষ্য গ্রহণসহ একে একে অন্তত ৯টি ধাপ পেরিয়ে হত্যা মামলার তদন্ত শেষ মাত্র ২২ ঘণ্টায়। পরবর্তী ২০ ঘণ্টার মধ্যে আসামিকে আদালতে হাজির, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়সহ তদন্তের সব প্রক্রিয়া শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। অর্থাৎ, মরদেহ উদ্ধার থেকে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিতে পুলিশের সময় লেগেছে মাত্র ৪২ ঘণ্টা।

একটি খুনের মামলার তদন্তে এমন ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায়। দুই দিনের কম সময়ে খুনের মামলার তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়ার ঘটনায় অনেকে প্রশংসা করলেও প্রশ্ন তুলেছেন আইন ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, মামলাটির তদন্ত শেষ হয়েছে রকেটের চেয়েও দ্রুতগতিতে। এটা ব্যতিক্রমী ও আশ্চর্য্যজনক ঘটনা। পুলিশের এমন তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যেরাও।

গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে মানিকগঞ্জ সদরের কৈতরা গ্রামের একটি হ্যাচারিতে খুন হন মো. রুবেল (২২)। পরদিন নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে সোহেল নামের একজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এখন কারাগারে।

পুলিশ জানায়, রাত ১২টা ১০ মিনিটের দিকে রুবেল খুন হন। ৪০ মিনিট পর সোহেল ওরফে নুরনবী (৩০) নামের এক তরুণ থানায় গিয়ে নিজে রুবেলকে খুন করেছেন বলে দাবি করেন। পুলিশ সোহেলকে নিয়ে সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে রাত দেড়টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। সেখান থেকে একটি রামদা উদ্ধার করা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে রাত ১টা ৫০ মিনিটের দিকে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। তখন দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়।

পুলিশ আরও জানায়, ২৪ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টার দিকে হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নেয় পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন, তথ্য সংগ্রহ, ঘটনাস্থলের মানচিত্র তৈরি করেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে রুবেলের স্ত্রী চম্পা আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। পরে ওই মামলায় সোহেলকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। পরদিন ২৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা পর্যন্ত সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হলে তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। বিকেলে সোহেল জবানবন্দি দিলে ওই দিন সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

মানিকগঞ্জ জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুস সালাম ৩০ বছর ধরে আইন পেশায় আছেন। গত সোমবার তিনি বলেন, ‘এমন অভিযোগপত্র দেওয়ার ঘটনা আগে আমার দৃষ্টিতে আসেনি। পুলিশ অল্প সময়ে অভিযোগপত্র দিতে পারে। এতে আইনি কোনো বাধা নেই। তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তদন্ত নির্ভুল হওয়া প্রয়োজন। সঠিক ও নির্ভুল তদন্তের জন্য আরেকটু সময় নেওয়ার দরকার ছিল।’

সম্প্রতি মামলার বাদী-বিবাদীর স্বজনেরা হাইকোর্টের এক আইনজীবীকে বিষয়টি জানান। মামলার তদন্তপ্রক্রিয়া যথাযথ হয়েছে কি না, সেটা তদন্ত করতে ওই আইনজীবী বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

হ্যাচারিমালিক নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে বাদী-বিবাদী কাউকে কোনো বাধা দেওয়া হচ্ছে না।’

দুই কারণে হত্যা : পুলিশ বলছে, দুই কারণে রুবেলকে হত্যা করা হয়। একটি হচ্ছে মালিকের অনুপস্থিতিতে হ্যাচারির ইট চুরি করে বিক্রি করেছিলেন তাঁরা। ওই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ ছাড়া ছোট বোনের জামাই হয়ে নুরনবীকে বলাৎকারের চেষ্টা করেন রুবেল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন সোহেল। পরে অনুতপ্ত হয়ে নিজেই থানায় গিয়ে পুলিশকে খবর দেন।

তবে তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী চম্পা। তিনি সোমবার বলেন, ‘আমি যেভাবে চেয়েছিলাম, পুলিশ সেভাবে মামলা নেয়নি। ভাই আমার সন্তানদের এভাবে এতিম করবে, এটা বিশ্বাস হয় না।’ চম্পার অভিযোগ, সবকিছুতেই পুলিশ বেশি তাড়াহুড়া করেছে। তবে ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি তিনি।

হত্যা মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অনেকটা ‘ঝড়ের’ গতিতে মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। দীর্ঘ চাকরিজীবনে এমন তদন্তের কথা তাঁরা শোনেননি। তাঁদের ভাষ্য, খুনের ঘটনার খবর পেলেই একজন উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে যাবেন। আত্নীয়স্বজন পাওয়া গেলে তাঁদের দিয়ে মরদেহ শনাক্ত করাবেন। স্থানীয় দুই থেকে তিনজন সাক্ষী রাখবেন। এরপর মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে পাঠাবেন। এসব কাজ শেষে পুলিশ খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন করবে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, মামলায় বাদী কারও নামোল্লেখ করলে পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আসামি ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে রাজি হলে পুলিশ তাঁকে আদালতে পাঠাবে। আসামি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিলে ম্যাজিস্ট্রেট ও আসামি স্বাক্ষর করবেন। পাশাপাশি তদন্ত কর্মকর্তা খুনের ঘটনার তথ্যপ্রমাণাদি সংগ্রহ করবেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে দেখবেন, আসলে তাঁকে খুন করা হয়েছে কি না। এ ছাড়া সাক্ষীর জবানবন্দি লিখে নেবেন। তদন্তে যা পাওয়া গেছে, তা নথি আকারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠাবেন। তাঁরা যাচাই–বাচাই করে অভিযোগপত্র দেওয়ার অনুমতি দেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে পাবলিক প্রসিকিউটরের কাছে মতামতের জন্য পাঠান।

তবে মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ গোলাম আজাদ খান বলেন, খুনের কারণ ও জড়িত ব্যক্তি শনাক্ত হলে যেকোনো সময় অভিযোগপত্র দেওয়া যায়। এক দিনের মধ্যে দিলেও কোনো আইনি বাধা নেই।

থানায় এসে সোহেলের হত্যার দায় স্বীকার : রাত ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে মানিকগঞ্জ সদর থানায় আসেন সোহেল। থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তার (ডিউটি অফিসার) কক্ষে ঢুকে বলেন, ‘আমি খুন করেছি। মামুনের হ্যাচারিতে লাশ পড়ে আছে।’

জানা গেছে, মানিকগঞ্জের কৈতরা এলাকায় ব্যবসায়ী নাছির উদ্দিন (মামুন) এর একটি হ্যাচারি ও একটি ইটভাটা রয়েছে। তিনি থাকেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। তাঁর হ্যাচারিতে কাজ করতেন রুবেল ও সোহেল। তাঁরা সম্পর্কে আপন খালতো ভাই। রুবেল আসামি সোহেলের ছোট বোনের জামাই।

পুলিশ জানায়, ঘটনার ১৫ দিন আগে ওই হ্যাচারিতে কাজে যোগ দেন রুবেল। এক সপ্তাহ পর আসেন সোহেল। রুবেলের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার থানেশ্বরে। সোহেলের বাড়ি নেত্রকোনায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তাড়াহুড়া করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এ যেন ‘সুপারম্যানের’ ভূমিকা নিয়েছে পুলিশ। এভাবে তদন্ত শেষ করতে গেলে অনেক সময় ভুল হয়। এতে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তি ফেঁসে যায়।

সোমবার সরেজমিন দেখা গেছে, হ্যাচারির মূল ফটকে তালা ঝুলছে। চিনোরানী সরকার নামের এক নারী বলেন, খুনের ঘটনার পর থেকে ফটকে তালা দেওয়া হয়েছে। গত এক মাসে সেখানে তিনি কাউকে দেখেননি।

তদন্ত কর্মকর্তা যা বলেন : সবকিছু মেনেই তদন্ত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মানিকগঞ্জ সদর থানার এসআই মাকসুদুর রহমান। তিনি বলেন, সোহেল শুরু থেকেই নিজেকে খুনের ঘটনায় জড়িত দাবি করে আসছেন। তা ছাড়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও পারিপার্শ্বিকতা পর্যালোচনা করে সোহেল এ ঘটনায় জড়িত বলে মনে হয়েছে।

মাকসুদুর রহমান বলেন, হত্যার কথা স্বীকার করলেও কারণ বলছিলেন না সোহেল। রাত থেকে পরদিন সকাল ১১টা পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে তিনি হত্যার দুটি কারণ বলেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘আমার চার দশকের আইন পেশায় এমনটা শুনিনি। এ ঘটনা শুনে আমি চরম অবাক হলাম। খুনের মামলার তদন্ত যদি এত অল্প সময়ের মধ্যে করা যায়, তাহলে অন্যান্য মামলার তদন্তের বিলম্ব কি ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে?

Share