নয়াবার্তা প্রতিবেদক : দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান চালু করে বহুল আলোচিত আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম ওরফে আপনকে দুবাইয়ে পুলিশ আটক করেছে। দেশে হত্যাসহ ১২ মামলার এই আসামির বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির এক দিনের মাথায় গত সোমবার রাতে তাকে আটক করা হয়। অবশ্য তাকে দুবাইয়ে আটকের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয়নি।
বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবি শাখার সূত্র বলছে, রেড নোটিশ পাওয়ার পর দুবাই পুলিশ আরাভের ওপর সরাসরি নজরদারি বসায়। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তার ফ্ল্যাট সেফহোম হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে তার মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়নি। তাকে কীভাবে পুশব্যাক করবে সে সিদ্ধান্ত নেবে সেদেশের সরকার। ততদিন পর্যন্ত পুলিশের তত্ত্বাবধানেই থাকবেন তিনি।
সূত্র বলছে, দুবাই থেকে আরাভকে ফেরাতে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) শাখা ও দুবাই পুলিশের ইন্টারপোল শাখার প্রতিনিধিরা গতকাল রাতেও ভিডিও কলে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক দিনের মধ্যেই তাকে ফেরত পাঠানো হবে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রহণ করবে দেশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ঢাকায় ডিবি এবং এনসিবি কর্মকর্তারা বলছেন, রেড নোটিশের আবেদন করার পর দুবাই পুলিশ আরাভকে আইনের আওতায় নিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে বলে তারা জেনেছেন।
জানতে চাইলে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. আবু জাফর মোবাইল ফোনে বলেন, ‘এখনো আমাদের অফিসিয়ালি জানানো হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমে আরাভের বিষয়ে জানানো হয়েছে, তাকে নজরদারি করা হয়েছে এবং তার চলাফেরা সীমিত করে আনা হয়েছে।’
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘এটা এখনো আনফোল্ডিং, আপনারা সময়মতো জানতে পারবেন। তবে তিনি পালিয়ে থাকতে পারবেন না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মনজুর হোসেন বলেন, ‘আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো এ বিষয়ে কোনো চিঠি পাইনি। চিঠি না পেলে কিছুই বলতে পারব না।’
দুবাইয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, আরাভকে বাংলাদেশের নাগরিক দাবি করে ১২ মামলার পলাতক আসামি হিসেবে রেড নোটিশ জারি করায় তার ভারতীয় পাসপোর্ট স্থগিত করেছে দেশটি। তিনি ভারতীয় নাগরিক হিসেবে দুবাইয়ে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে পাসপোর্ট বাতিল হওয়ায় আরাভ অবৈধ নাগরিক হয়ে গেছেন এবং তার বসবাসের অনুমোদনও বাতিল হয়ে যায়। সে হিসেবেই তাকে আটক করে ডিটেনশন সেন্টারে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হত্যা মামলার আসামি আরাভ খানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশের পর চাপের মুখে হঠাৎ তার স্বর্ণের দোকান ‘আরাভ জুয়েলার্স’ ফাঁকা করে ফেলেছেন। সেখানে নেই কোনো স্বর্ণালংকার। দোকানটিও গতকাল থেকে বন্ধ দেখা যাচ্ছে বলে দুবাইয়ের একাধিক প্রবাসী সূত্র জানিয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত সপ্তাহে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন করার পর ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় জুয়েলার্সের মালিক আরাভ খানকে নিয়ে। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়া ও বিনোদন জগতের অনেক তারকাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দিয়েছিলেন আরাভ খান। তখনই তাকে পুলিশ সদস্য হত্যা মামলার আসামি বলে শনাক্ত করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যমতে, আরাভ খানের আসল নাম রবিউল ইসলাম। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তার বাড়ি। তিনি সোহাগ মোল্লা, হৃদয় শেখ, আপন—এরকম কয়েকটি নামে পরিচিত। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই ঢাকায় পুলিশের পরিদর্শক মামুন এমরান খান খুন হন। সেই খুনের আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন রবিউল।
মামলা ও নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া একটি চক্রের কবলে পড়েন পরিদর্শক মামুন এমরান। এরপর তাকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পেট্রোল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুরের জঙ্গলে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা।
গত সোমবার পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। ইন্টারপোল সেই আবেদন গ্রহণ করেছে।
মামুন হত্যায় বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ : পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলায় আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলার বাদী জাহাঙ্গীর আলম খানের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। গতকাল ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফয়সল আতিক বিন কাদেরের আদালতে জেরার মধ্য দিয়ে তার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। এ নিয়ে মামলাটিতে ৩৮ সাক্ষীর মধ্য দিয়ে একজনের সাক্ষ্য শেষ হলো।
এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন সুরাইয়া আক্তার কেয়া, রহমত উল্লাহ, স্বপন সরকার, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সারোয়ার হাসান ও দিদার পাঠান। তাদের মধ্যে আরাভ ও কেয়া পলাতক।
এদিন কারাগারে আটক ছয় আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাদের উপস্থিতিতে মামলার বাদীকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। জেরা শেষে আদালত পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৪ জুন দিন ধার্য করেন। এর আগে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই মামলার বাদী জাহাঙ্গীর আলমের জবানবন্দি রেকর্ড করেন আদালত।
২০১৮ সালের ৭ জুলাই বনানীতে খুন হন পুলিশ পরিদর্শক মামুন। ঘটনার তিন দিন পর তার ভাই বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ এ মামলায় রহমত উল্লাহ, রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর আদালত এ মামলার অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন।