নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ঢাকার পল্লবীর আদর্শনগর এলাকায় একটি বাড়িতে পুলিশের ‘মাদকবিরোধী’ অভিযানের মধ্যে এক তরুণীর মৃত্যুর পর ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর সঙ্গে মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে, ভাংচুর হয়েছে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি।
সোমবার রাতে অভিযানের সময় ওই তরুণীকে পুলিশ গলাটিপে হত্যা করেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা পুলিশকে অবরুদ্ধ করে ফেলে।
পুলিশ বলছে, ওই তরুণী আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যা মানলেও তাতে প্ররোচনার জন্য পুলিশকেই দায়ী করেছে তার স্বজনরা।
এই ঘটনার তদন্ত হবে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, যে তরুণী মারা গেছেন, সেই বৈশাখী বেগম এবং তার মা লাভলী বেগম মাদক বিক্রি করেন। তাদের বাড়ি থেকে ২ কেজি গাঁজা ও কয়েকশ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। লাভলীকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনার পথে তিনি পালিয়ে যান।
স্থানীয়রা বলছেন, বৈশাখীর বয়স ১৬ বছরের বেশি নয়, তবে বছর খানেক আগে তিনি বিয়ে করেন। পুলিশের ভাষ্য মতে, বৈশাখীর বয়স ১৯ বছর।
মাদক কেনাবেচার অভিযোগে বৈশাখীর বিরুদ্ধে চারটি এবং তার মা লাভলীর বিরুদ্ধে সাতটি মামলা রয়েছে বলেও পুলিশ জানিয়েছে।
আদর্শনগর এলাকার কয়েকজন জানিয়েছেন, লাভলীর বাড়িতে মাদক বিক্রির খবর তারা জানেন। তবে ওই বাড়িতে পুলিশের সোর্সদেরও নিয়মিত আনাগোনা রয়েছে। পুলিশ সদস্যদের ছত্রছায়ায় সেখানে মাদক কারবার চলে।
ঘটনার সূত্রপাত
আদর্শনগর এলাকার পৌনে এক কাঠার একটি প্লটে চারতলা বাড়িতে লাভলী থাকেন। বাড়ির মালিক তার বাবা মাইনুদ্দীন মিজি মারা গেছেন।
মাইনুদ্দীনের স্ত্রী রহিমা খাতুন জানান, তাদের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে লাভলী সবার বড়। ওই বাড়িতে তিনি, লাভলী, ছোট ছেলে আর সেজ ছেলে পরিবারসহ থাকেন। দুটি ঘর ভাড়া দেওয়া আছে। লাভলী ও তার স্বামী ডিটারজেন্ট পাউডারের ব্যবসা করেন।
লাভলীর চার মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে বৈশাখী সেজ। বৈশাখী স্বামীর সঙ্গে মিরপুরেরই বাউনিয়া এলাকায় থাকেন। সোমবার বিকালে মায়ের বাড়িতে এসেছিলেন।
স্বজনরা বলছেন, লাভলীকে গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযানে এলে বৈশাখী বাধা দেন, পরে আত্মহত্যা করেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রহিমা বলেন, “সন্ধ্যার দিকে আমি ঘুমায়া রইছি। এমন সময় পুলিশ আইসা ঠাস ঠাস কইরা গেট পিটতেছে। লাভলী আর ওর তিন মাইয়া আছিল চাইর তালায়, নাইমা আইসা লাভলী আমারে কয়, ‘মা, গেট খুলিস না’। আমি কইলাম খুলুম না কেরে? পুলিশ বাইরে থিকা লাথি দেয় আর কয় ‘গেট ভাঙ’। আমি গেটের কাছে গিয়া কইলাম, আপনেরা আইনের লোক, আমার শরীর কাঁপতে আছে। আমার পোলারা বাইরে গেছে, হ্যারা আসুক।
“তারা লাইত্থাইতেই আছি, আমি হেরপরে আমি গেট খুললাম। খুললাম মাত্র তারা হুড়মুড় কইরা ঢুইকা গেল চাইর তলায়। এরপর আইছে দুই তলায়। সেইখানে চেক কইরা আবার আইছে নিচতলায়। আমি তিন ঘর খুইলা দিছি। এই সময় হ্যারে (বৈশাখী) ঘরে আটকায়া তালা দিয়া থুইয়া আইছে। হ্যারে ঘরে না আাটকাইলে হেই ছেরি মরত না। আর ওর মারে (লাভলী) ওই বাড়িত গিয়া মাইরা-ধইরা ল্যাংটা-ছোংটা বানাইয়া ফালাইছে।”
“আমি কই বাড়ি-ঘর কী ছাইড়া যামুগা। পুলিশ কয়, ‘বেইচ্চা ফালান’। আমি কইছি, বেচমু ক্যা, কষ্ট কইরা বানাইছি খাইয়া মরমু,” বলেন বৈশাখীর নানী।
রহিমার দাবি, বৈশাখীর লাশ যখন ঘরে ঝুলছিল, সেই অবস্থায় পুলিশ লাভলীকে ঘটনাস্থল থেকে রক্তাক্ত ও বিবস্ত্র অবস্থায় ধরে নিয়ে যায়।
তবে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার জসীমউদ্দীন মোল্লা বলছেন, আদর্শনগর থেকে থানায় আনার পথে লাভলী পালিয়ে গেছেন।
আত্মহত্যায় পুলিশের প্ররোচনার অভিযোগ : বৈশাখীর ভাই আতাউর রহমান আকাশ দাবি করেন, অভিযানে আসা পল্লবী থানার এসআই জহিরের প্ররোচনায় তার বোন বৈশাখী আত্মহত্যা করেছেন।
তিনি বলেন, অভিযানের সময় তারা বোনেরা পুলিশের কাছে অনুরোধ করেছিল তাদের মাকে যেন ধরে না নিয়ে যাওয়া হয়। তখন এসআই জহির ২ লাখ টাকা দাবি করেন, না হলে তার তিন বোন ও মাকে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন। তারা ৫০ হাজার টাকা দিতেও চেয়েছিলেন। এর মধ্যেই তার মাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বৈশাখীকে তিন তলার একটি ঘরে তালা মেরে রাখেন এসআই জহির। বৈশাখীকে আত্মহত্যা করতে একটি ওড়নাও ছুড়ে দেন জহির।
তিন ঘণ্টা বৈশাখীর লাশ ঝুলে থাকলেও পরিবারের কাউকে পুলিশ সেদিকে যেতে দেয়নি বলে জানান আকাশ।