সিম কিনতে এসে ফাঁদে পড়ছেন গ্রাহকরা, জড়িত কোম্পানির প্রতিনিধিরা

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : পীরগঞ্জে গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ারে চাকরি করতেন দুই সহোদর আল আমিন মিয়া ও আরাফাত রহমান। কাস্টমার কেয়ারে চাকরির সুবাদে প্রতিদিনই অনেক গ্রাহক তাদের কাছে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও সেবা নিতে যেতেন। তারাও গ্রাহকদের চাহিদামতো সেবা দিতো। এই সেবা আদান- প্রদানের মধ্যদিয়ে দুই সহোদর গ্রাহকের বিভিন্ন তথ্য নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করে রাখতো। সিম সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করায় তাদের কাছে গ্রাহকের বায়োমেট্রিক তথ্য থাকতো। তারা এসব তথ্য টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন অপরাধী ও একটি চক্রের কাছে তুলে দিতো। পরে এসব তথ্য ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতো। একইভাবে এম এন ট্রেডার্স নামের একটি বাংলালিংক কোম্পানির ডিলার হাউজে সেলস রিপ্রেজেনটিভ হিসেবে চাকরি করতেন মো. মাসুদ, ইমন হোসেন, সোহেল রানা ও মো. শাকিল।

তারাও তথ্য বিক্রির কাজ করতেন। তাদের কাছে সিম কিনতে আসা গ্রাহকদের হাত পরিষ্কারের নামে একটি বিশেষ রাবারসদৃশ বস্তুতে ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে গ্লু-গানের সহায়তায় আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে রাখতো। পরে ওই গ্রাহকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে নতুন করে সিম রেজিস্ট্রেশন করে তাদের কাছে রেখে দিতো।

আগে থেকে অ্যাকটিভ করা এসব সিমের জন্য তাদের রেডি করা ক্রেতা থাকতো। তারা বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়ে এসব সিম কিনে নিতো। প্রতিটি সিম তারা গ্রাহক বুঝে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি করতো। অপরাধীরা এসব সিম নিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ফোনে কথা বলা, লেনদেনের জন্য বিকাশ, নগদ, রকেট ছাড়াও অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা কাজ করতো।

তারা যখন এসব সিম ব্যবহার করে অপরাধ করতো আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের খুঁজে বেড়াতো তখন প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়তো না। বরং উল্টো যাদের তথ্য দিয়ে সিম রেজিস্ট্রেশন হতো তারা ফেঁসে যেতেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) এসআই মো. আফজাল হোসাইন অনলাইনে সাইবার ক্রাইম মনিটরিং করতে গিয়ে ডিজিটাল সার্ভিস প্রো নামের একটি ফেসবুক পেজের পোস্টে দেখতে পান মোবাইল সিম বায়োমেট্রিক, মোবাইল কললিস্ট, এসএমএস লিস্ট, বিকাশ, নগদ-এর বিভিন্ন তথ্য টাকার বিনিময়ে সরবরাহ করা হয়। পোস্টের সত্যতা পেয়ে তিনি পোস্টদাতার অবস্থান শনাক্ত করে মো. মাসুদ নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেন।

পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়- ইমন, সোহেল রানা, শাকিলদের সহযোগিতায় সে প্রতারণামূলকভাবে তার কাছে সিম কিনতে আসা ব্যক্তিদের হাত পরিষ্কার করার নামে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে গ্রাহকের এনআইডি দিয়ে সিম অ্যাকটিভ করে পরে সেগুলো বেশি দামে বিক্রি করতো। তার ব্যবহার করা মোবাইল ফোন পর্যালোচনা করে দেখা যায় ডিজিটাল সার্ভিস প্রো নামক ফেসবুক পেজ এবং হোয়াটসঅ্যাপে মেহেদী হাসান, নুর আলম, আল আমিন, আরাফাতের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য তারা একে অপরকে সরবরাহ করে। পরে সেগুলো অপরাধীদের কাছে বিক্রি করে। ডিবি সাইবারের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, মাসুদ বাংলালিংক, রবি, এয়ারটেল, টেলিটক কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় এসব তথ্য বের করে আনতো। মাসুদ মেহেদী হাসানের সহযোগিতায় টিকটক প্রো নামে একটি বিশেষ অ্যাপস তৈরি করে। এই অ্যাপসে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানি, জাতীয় পরিচয়পত্রের এপিআই সরবরাহ করে।

এই অ্যাপসের মাধ্যমে সিমের বায়োমেট্রিক, এনআইডি টু মোবাইল নম্বর, নগদ, বিকাশ এনআইডি তথ্য, রবি-এয়ারটেল টাওয়ার লোকেশন, সিম লোকেশন, আইডি কার্ড সার্ভার কপি, আইডি কার্ড সাইন কপি, জন্মনিবন্ধন বের করে। এ ছাড়া তারা নির্বাচন কমিশনের সার্ভার হ্যাক করে বেআইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। চক্রটির কাছ থেকে বিশেষভাবে সংরক্ষিত প্রায় ৮০০ মানুষের আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা হয়েছে। ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, চক্রের মূলহোতা মাসুদসহ বাংলালিংক, গ্রামীণফোনে চাকরি করেন এমন ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। তারা বেশিদূর পর্যন্ত লেখাপড়া না করলেও প্রযুক্তিগত বিদ্যায় প্রত্যেকেই পারদর্শী।

সিম কিনতে আসা গ্রাহকের অজান্তেই তারা বিশেষ উপায়ে আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে নিতেন। গ্রাহকদের জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের তথ্য, সিম লোকেশন, টাওয়ার লোকেশনসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে তারা টাকার বিনিময়ে সরবরাহ করতো। তাদের কাছে গ্রাহকের তথ্য সংরক্ষিত থাকার কথা। অথচ লোভে পড়ে তারা এসব তথ্য তুলে দিচ্ছে অপরাধীদের হাতে। অপরাধীরা এসব তথ্য ও গ্রাহকের বায়োমেট্রিক তথ্য সংবলিত সিম ব্যবহার করে তাদের ফাঁসাচ্ছে। কারণ যখন একটি অপরাধ ঘটে তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যার নামে সিম রেজিস্ট্রেশন করা তাদেরকেই আইনের আওতায় আনবে। তাই এসব বিষয়ে গ্রাহকদের যেমন সচেতন হওয়া দরকার ঠিক তেমনি বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির ঊর্ধ্বতনদের এসব বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়া দরকার।

Share