নয়াবার্তা প্রতিবেদক : আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে দুটি ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের লেটার অব ইনটেন্ট বা সম্মতিপত্র (এলওআই) দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও ৬টি প্রতিষ্ঠান নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। সবমিলিয়ে পর্যায়ক্রমে ৮টি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংক খুলতে পারবে।
এলওআই পাওয়া ডিজিটাল ব্যাংকগুলো হলো— নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি।
রোববার (২২ অক্টোবর) গভর্নর আব্দুল রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় নতুন ডিজিটাল ব্যাংক অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।
তিনি বলেন, নগদ টাকার ব্যবহার কমিয়ে আনার পাশাপাশি লেনদেনকে সহজ করতে ডিজিটাল ব্যাংক চালুর উদ্যোগে সাড়া দিয়ে ৫২টি আবেদন পড়ে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে ৮টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে নগদ ডিজিটাল ব্যাংক, কড়ি ডিজিটাল ব্যাংককে এলওআই দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও ৬টি পাবে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে; তারা ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত। তাদের জন্য নতুন নীতিমালা দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে ডিজিটাল ব্যাংকিং ইউং খোলে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এর মধ্যে আছে ব্র্যাক ব্যাংকের এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশের বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক। ব্যাংক এশিয়ার ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, ডিজি টেন ব্যাংক পিএলসি।
ডিজি টেন জোটে আছে- সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।
এছাড়া আরও তিন প্রতিষ্ঠানকে ছয় মাস পর অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো- স্মার্ট ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, জাপান বাংলা ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, নর্থ ইস্ট ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি।
এ বিষয়ে মুখপাত্র জানান, যারা এলওআই পেয়েছে তাদের ৬ মাসের মধ্যে মূলধন সংগ্রহসহ শর্ত পূরণ করে কার্যক্রমে আসতে হবে। তাদের লাইসেন্সবাবদ গুণতে হবে তিন কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল ব্যাংকিং উইং খোলার সময় দুই কোটি টাকা ফি দিতে হবে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়াদ শেষের দিকে। সবকিছু ঠিক থাকলে জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তাই উদ্যোক্তারা সরকারকে এ ব্যাপারে এক ধরনের চাপ তৈরি করেন। কারণ, নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হলে তখন হয়ত পুরো বিষয়টি ফাইলবন্দি হয়ে যাবে। তাই উদ্যোক্তাদের লবিং ও সরকারের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদে ১৪টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিশেষ আইনে গঠিত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক তফশিলি ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন হয়। সব মিলিয়ে দেশে প্রচলিত ধারার ব্যাংক আছে ৬১টি।
মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) নগদের প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানের নাম ‘নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’ এর উদ্যোগে রয়েছে নগদের বর্তমান উদ্যোক্তা, সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান ফরিদ খানসহ আরও বেশ কয়েকজন। মোবাইলে আর্থিক সেবার পূর্ণ লাইসেন্স পায়নি নগদ, তাই ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়ে নগদকে পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে কড়ি ডিজিটাল ব্যাংকের মূল উদ্যোক্তা হাবিবুল্লাহ এন করিম। তিনি সাবেক অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের স্বামী।
ডিজিটাল ব্যাংক কী : ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য শুধু প্রধান কার্যালয় থাকবে। সেবা প্রদানে এই ব্যাংকের আর কোনো স্থাপনা, ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি), শাখা, উপশাখা, এটিএম, সিডিএম অথবা সিআরএম বুথ ছাড়াই পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর চলবে ‘ডিজিটাল ব্যাংক’। থাকবে না সশরীরে লেনদেনের কোনো ব্যবস্থা। মোবাইল, অ্যাপনির্ভর আর ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহারে গ্রাহকদের দেবে ব্যাংক সেবা।
‘ডিজি ১০ ব্যাংক পিএলসি’ নামে হচ্ছে ডিজিটাল ব্যাংক : সেবা মিলবে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা। ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চ্যুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও অন্য কোনো উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য চালু করতে পারবে। কোনো প্লাস্টিক কার্ড দিতে পারবে না। এ ব্যাংকের গ্রাহকেরা অবশ্য অন্য ব্যাংকের এটিএম, এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। এটি ঋণপত্রও (এলসি) খুলতে পারবে না। শুধু ছোট ঋণ দেবে, বড় ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দেওয়া যাবে না। তবে আমানত নিতে কোনো বাধা নেই।
নতুন ব্যাংকিং ব্যবস্থা ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মূলধন ১২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে, প্রথাগত ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম মূলধন লাগে ৫০০ কোটি টাকা।
নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল ব্যাংকে প্রত্যেক স্পন্সরের সর্বনিম্ন শেয়ারহোল্ডিং হবে ৫০ লাখ টাকা (সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা ১২.৫ কোটি টাকা)।
ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালিত হবে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রণীত গাইডলাইন বা নির্দেশিকা অনুসারে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনে উদ্যোক্তাদের অর্ধেককে হতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
বাকি অর্ধেককে হতে হবে ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) ব্যাংক পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা : অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালাও চূড়ান্ত করে ফেলেন। চলতি বছরের ১৪ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংক্রান্ত একটি ডিজিটাল ব্যাংক নির্দেশিকা প্রকাশ করে। সে নির্দেশিকা অনুসারে, এ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে কোনো লেনদেন হবে না।
আগামী অর্থবছরেই চালু হচ্ছে ডিজিটাল ব্যাংক : অর্থমন্ত্রী
নির্দেশিকা অনুসারে, ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন জমা দেওয়ার সুবিধার্থে গত ২১ জুন একটি ওয়েব পোর্টাল চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। লাইসেন্স পেতে আবেদনকারীদের প্রাথমিকভাবে ১ আগস্টের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়েছিল। তবে এর মধ্যে সাড়া না পাওয়ায় আবেদনের সময়সীমা ১৭ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
নতুন ধারার ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ করতে আবেদন করে দেশি-বিদেশি ৫২টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক, মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস), রাইড শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি, তথ্য প্রযুক্তি সেবাদানকারী, ওষুধ কোম্পানির মতো দেশি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স পেতে কেউ এককভাবে আবেদন করেছে আবার যৌথ উদ্যোগেও আবেদন জমা পড়েছিল।