গাজী আবু বকর : শতাধিক খাতে লক্ষাধিক কোটি টাকার কর অব্যাহতি কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর অব্যাহতি কমানোর লক্ষ্যে কাজ করছে এই কমিটি। মূলত এনবিআরের কর বিভাগ কর অব্যাহতির একটি সুস্পষ্ট গাইডলাইন তৈরির উদ্দেশ্যেই এই কমিটি গঠন করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এনবিআর ইতিমধ্যে কর অব্যাহতি সংস্কৃতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১০২টি খাতে বর্তমানে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর অব্যাহতি পাওয়ার তথ্য প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪০টি খাতে ব্যক্তি করদাতাদের অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। বাকীগুলোতে কোম্পানি, শিল্প বা বিনিয়োগের জন্য আংশিক বা পুরোপুরি অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিভিন্ন ধরনের কর রেয়াত বা অব্যহতির কারণে সরকার ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই কর রেয়াতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে কর অব্যহতির পরিমাণ বেড়েছে ৫২ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে যা ৪২ শতাংশ। আর আলোচ্য সময়ের জিডিপির ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কর অব্যাহতি পরিমাণ ৮৫ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যক্তি খাতের কর অব্যাহতির পরিমাণ ৪০ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা।
ব্যক্তি খাতের কর অব্যাহতির মধ্যে পোল্ট্রি খাতের করদাতারা কর অব্যাহতি পেয়েছেন ২ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এছাড়া ক্যাপিটাল গেইন ৯৮৫ কোটি টাকা এবং রেমিট্যান্সে কর অব্যাহতি ১১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা।
প্রাতিষ্ঠানিক বা সবচেয়ে বেশি করপোরেট কর অব্যাহতির মধ্যে রয়েছে আইটি বা সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান, পোশাক খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, মাইক্রো ফাইন্যান্স ও ইকোনমিক জোন। এসব শিল্প সম্মিলিত ভাবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি কর অব্যাহতি পেয়েছে। আইটিতে ১ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা, পোশাক খাতে ৩ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ৮ হাজার ৩৮০ কোটি কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রো ফাইন্যান্সে ১৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা ও ইকোনমিক জোনে ৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
কমিটিকে কর অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নন-অপারেটিং আয়ের ক্ষেত্রগুলো আলাদাভাবে বিবেচনা করা, অব্যাহতি যাতে অবারিত না হয় তা খেয়াল রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অব্যাহতির ক্ষেত্রে ট্রাস্টের কর্মপরিধি ও গঠন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করা, কোম্পানির করদাতারা যেন করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির সুবিধার অপব্যবহার না করতে পারে তা পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি যেসব আদেশের (সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ) মেয়াদ শেষ, সেগুলো বাতিলের সম্ভাব্যতাও যাচাইয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। কর অব্যাহতির বিষয়টি যাতে অবারিত না থাকে, সে বিষয়ে লক্ষ্য রেখে কেবলমাত্র যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অব্যাহতি পাওয়ার যোগ্য তাদেরকে এ সুবিধা দিতে কাজ করবে কমিটি। স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় শিল্পের এমন কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে দেওয়া শুল্ক সুবিধাও পর্যালোচনা করে অব্যাহতি কমানোর পরিকল্পনা করবে এই কমিটি। এই পদক্ষেপের ফলে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক করদাতারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কর অব্যাহতির কিছু সুবিধা হারাতে পারেন। স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহ দিয়ে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পকে সাহায্য করতে এই পদক্ষেপ নিয়েছে এনবিআর।
উল্লেখ্য, কর অব্যহতিকে আক্ষরিক অর্থে বলা হয় ‘প্রত্যক্ষ করব্যয়’ বা ডিরেক্ট ট্যাক্স অ্যাক্সপেনডিচার। প্রত্যক্ষ করব্যয়ের বিশালত্বের কারণে দেশের কর-জিডিপি’ হার বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনীতিবিদরা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রক্ষেপিত মোট জিডিপির আকার বিবেচনায় নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রক্ষেপিত ‘প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ে’র মোট পরিমাণ গিয়ে ঠেকবে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকার ঘরে। আবার এর সাথে প্রাক্কলিত ভর্তুকির পরিমাণ যোগ করলে এর পরিমাণ গিয়ে ঠেকবে দুই লাখ ৮৯ হাজার ২২৮ কোটি টাকা।
এ দিকে কর-জিডিপির হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি অন্যতম প্রতিবন্ধক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি গত মাসে জাতীয় সংসদে দেয়া তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, অপরিহার্য কোনো কারণ ছাড়া আমরা কর অব্যহতির কোনো এসআরও (বিধিবদ্ধ আইনি প্রজ্ঞাপন) জারি করা পরিহার করব। এর ফলে রাজস্ব ঘাটতি কমে যাবে এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আসবে। অব্যাহতি প্রাপ্ত খাত থেকে কর আদায় করা হলে, প্রকৃত কর-জিডিপি অনুপাত অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এখন কর-জিডিপির হার ৯ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। যেমন-২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে। ফলে ১৪ বছরের ব্যবধানে কর-জিডিপির হার বেড়েছে মাত্র ০ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্য দিকে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশে এই হার ১৫ থেকে ২৫ শতাংশের ঘরে রয়েছে।