আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে চলছে দ্বৈতনীতি

আনোয়ারা পারভীন : আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফ্রেন্ডশিপ এনজিও পরিচালিত দেশের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল সমূহে চলছে দ্বৈত নীতি। দেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলা এবং দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী এবং সাতক্ষীরা জেলায় পরিচালিত স্থায়ী ও ভাসমান ৭টি হাসপাতালে একই পদে কর্মরত কর্মীরা পান ভিন্ন ভিন্ন স্কেলে বেতন। এসব হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা উচ্চ স্কেলে এবং স্থানীয় পর্যায়ে নিয়োগ প্রাপ্তরা নিন্ম স্কেলে বেতন পাওয়ায় কর্মীদের মধ্যে রয়েছে তীব্র অসন্তোষ।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ফ্রেন্ডশিপ এনজিও আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত একটি বেসরকারী সংস্থা। যা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চর দ্বীপুঞ্জের নদীগর্ভে ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় বেল্টে এবং দক্ষিণ-পূর্বের কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলিতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশের রুনা খান ফ্রেন্ডশিপ এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি একটি টেকসই, সমন্বিত উন্নয়ন পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষকে ক্ষমতায়নে কাজ করে। বর্তমানে ফ্রেন্ডশিপ এর কর্মচারী ১ হাজার ৫০০ এরও বেশি। যার মধ্যে ফিল্ড স্টাফ, আঞ্চলিক অফিসের কর্মী, ভাসমান হাসপাতালের কর্মীরা, ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের শিক্ষক, ভোকেশনাল স্কুলের প্রশিক্ষক, সংগঠন এবং দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে কর্মরত সুপারভাইজার এবং ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ের কর্মীরা অন্তর্ভুক্ত। ২০০৫ সাল থেকে, মোবাইল স্যাটেলাইট ক্লিনিকগুলির একটি সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছিল, যা তৃণমূল পর্যায়ে জনগোষ্ঠীর সেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা পরিপূরক। বর্তমানে, প্রতি মাসে, ফ্রেন্ডশিপের স্বাস্থ্য প্রোগ্রাম দ্বারা প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ব্যক্তি চিকিৎসা করা হয়। ফ্রেন্ডশিপের শিক্ষা, দুর্যোগ পরিচালনা, সুশাসন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ সম্পর্কিত প্রকল্প রয়েছে। এখন ফ্রেন্ডশিপ প্রতি মাসে প্রায় ৫ লাখ মানুষকে সহায়তা করে। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলা এবং দক্ষিণে পটুয়াখালী এবং সাতক্ষীরা জেলাসহ বাংলাদেশের ১৭ টি জেলায় ফ্রেন্ডশিপ সক্রিয় রয়েছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সোয়ালিয়া গ্রামে পরিচালিত ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা কাওছার গাজীর দানকৃত ২ একর জমির উপর ২০১৪ সালে এ হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত এ হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ৮০ শয্যার এ হাসপাতালের নকশা তৈরি করেছেন। বাতাসের গতিপথ বিবেচনায় রেখে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোর অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে মূল ভূখণ্ডের ওপর গড়ে তোলা এ স্থাপনার যাবতীয় বর্জ্য ধ্বংসে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এসটিপির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর আগে স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর নকশা করা গাইবান্ধার আরবানা ভবনটি আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পায়। ২০১৮ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। মূল স্থাপনার মধ্যে পাঁচটি ভবন আবাসিক ও ১৫টি স্বাস্থ্যসেবার কাজে ব্যবহৃত হয়। হাসপাতালটিতে কোন সীমানাপ্রাচীর নেই। হাসপাতাল অভ্যান্তরে রয়েছে ১০ ফুট প্রশস্ত জলাশয়। এরপর খানিকটা জায়গা ফাঁকা রেখে একতলা আর দুইতলা কিছু ভবন। ভবনগুলোতে নেই পলেস্তারা। ইটের গাঁথুনি আর ঢালাইয়ে বানানো দেয়াল ও ছাদ। এ স্থাপনা যুক্তরাজ্যভিত্তিক রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টসের (রিবা) ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য নির্বাচিতদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পায়। এ স্থাপনা ২০টি ভবনের সমন্বয়ে ৪৭ হাজার ৭৭২ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। স্থানীয় প্রযুক্তি ও নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে নির্মিত হাসপাতালে আউটডোর ও ইনডোর চিকিৎসাব্যবস্থার পাশাপাশি আছে অডিটরিয়াম, কনভেনশন সেন্টার, ক্যানটিন ও প্রার্থনাকক্ষ।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চিকিৎসক-নার্সসহ ৬২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসিক সুবিধা আছে। আছে অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থাও। এই হাসপাতালের অধিন শ্যামনগর ও পার্শ্ববর্তী কালিগজ্ঞ উপজেলায় ৭০টি স্যাটেলাইট ক্লিনিক পরিচালিত হচ্ছে। এসব স্যাটেলাইট ক্লিনিকে মাসে দুই বার স্বাস্থ্য সেবা প্রদাণ করা হয়। হাসপাতালটি ৬২ জন জনবল নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। হাসপাতালটিতে ২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মোট ৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন। ১৫ জন নার্স ও মেডিকেল এসিস্টেন্টের সহায়তায় এই ৬ জন চিকিৎসক প্রতিদিন ১৩০ থেকে ১৫০ জন রুগিকে প্রতিদিন আউটডোর চিকিৎসা সেবা প্রদাণ করেন। প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ জন মুমূর্ষ রুগি ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নেন। হাসপাতালটির পরিচালক মাসিক বেতন ভাতা পান ৩ লাখ টাকা। সিনিয়র চিকিৎসকরা পান ২ লাখ টাকা, মধ্যম পর্যায়ের চিকিৎসক পান ১ লাখ টাকা, জুনিয়র চিকিৎস পান ৫০ হাজার টাকা, কো-অর্ডিনেটর পান ৮০ হাজার টাকা, একাউন্ট অফিসার পান ৬৫ হাজার টাকা, আইটি অফিসার পান ৩০ হাজার টাকা, স্টোর কিপার পান ৩০ হাজার টাকা, বাবুর্চি ম্যানেজমেন্ট পান ২৮ হাজার টাকা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে স্থানীয়ভাবে নিয়োগকৃত নার্স ও মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট এর বেতন ভাতা ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ একই পদে কেন্দ্রীয় রেফারেন্সে নিয়োগকৃতের বেতন ভাতা ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। স্থানীয় পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত ওয়ার্ড সহকারি, রিসিপসনিষ্ট, সিকিউরিটি গার্ড, লন্ড্রি, ক্লিনারদের বেতন ভাতা ৬ থেকে ৮ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আবার একই পদে ১৫ হাজার টাকার বেতন ভাতার কর্মীও রয়েছে। পাশাপাশি ফ্রেন্ডশিপের অন্য শাখা থেকে বদলি হিসাবে আসা কর্মীদের বেতন ভাতাও দ্বিগুন। ফলে স্থানীয় নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছে চরম অসন্তোষ।

Share