দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থায় ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না, সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অভিযান চলবে বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমি কঠোর হয়েছি বলেই দুর্নীতিবাজেরা ধরা পড়ছে। এ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সরকারের ইমেজ (ভাবমূর্তি) নষ্ট হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না।’

সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গতকাল রোববার বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথাগুলো বলেন। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এই সংবাদ সম্মেলনে চীন সফর, শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন, বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী।

বিসিএসের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে যাঁরা উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করছেন, খুঁজে বের করা গেলে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান সরকারপ্রধান। বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, বেনিফিশিয়ারি যাঁরা, তাঁদেরও ধরা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ করবে না। কারণ, ঘুষ যে দেবে আর ঘুষ যে নেবে, উভয়ই অপরাধী। প্রশ্নপত্র যারা ফাঁস করে আর সেই প্রশ্নপত্র যারা ক্রয় করে, দুজনেই অপরাধী।’

বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২৪তম বিসিএস পরীক্ষা হয়েছিল ২০০২ বা ২০০৩ সালে। বিএনপি আমলে যত পরীক্ষা হতো আর যত চাকরি হতো, এটা কোনো পরীক্ষা না। হাওয়া ভবন থেকে তালিকা পাঠানো হতো।’

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করে গেছে পিয়ন, সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। এটা বাস্তব কথা। কী করে বানাল এই টাকা। যখন আমি জেনেছি, তাকে বাদ দিয়ে কার্ড সিজ করে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি।’

হেয় করার জন্য সমালোচনা
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চীন সফরে অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ—এই চার প্যাকেজের আওতায় দুই বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ প্রদানের সম্মতি পাওয়া গেছে। পাশাপাশি ২১টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

চীন সফরে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলেও সমালোচকেরা বলছেন, এ সফরে কোনো প্রাপ্তি নেই। এ বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই কথাগুলো বলে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা কি জেনে–বুঝে বলছেন, নাকি শুধুমাত্র আমাকে হেয় করার জন্য বলছেন, সেটাই প্রশ্ন। আমি বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিই না।’

চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘তার আগে ভারত গেলাম, সেখানে বলা হয়েছিল ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে এসেছি। চীনে গেলাম, বলে কিছুই দেয়নি। এটা একধরনের লোকের মানসিক অসুস্থতা বলে মনে করি।’

চীন সফরে অর্জন নেই—ভারতীয় গণমাধ্যমে এই প্রচার বেশি হচ্ছে বলে জানান একজন সাংবাদিক। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের গণমাধ্যমের কথা শুনে যাঁরা বললেন, তাঁরা তো দুই দিন আগেও বলেছেন ভারতের কাছে সব বিক্রি করে দিয়ে এসেছে সরকার। তাহলে কোনটা ঠিক?

ভারতের পত্রিকা কী লিখেছে, সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যাঁরা ভারতবিরোধী বক্তৃতা দিয়ে আবার ভারতের লেখা পড়ে মন্তব্য করেন, তাঁদের নীতিটা কী, সেটা বোঝা উচিত।

চীন থেকে নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে দেশে ফেরার বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘আমাদের কিন্তু ১১ জুলাই বিকেলে পৌঁছানোর কথা ছিল। সেখানে আর্লি মর্নিংয়ে আসছি। মাত্র ৫ ঘণ্টা বা ৬ ঘণ্টার পার্থক্য। এর মধ্যেই এত বড় তোলপাড় হয়ে যাবে, এটা তো বুঝতে পারিনি।’

‘এটা ভারত করুক’
তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন ভারত না চীন করবে—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধামন্ত্রী বলেন, ‘চীনও আমাদের কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল। তার সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে। ভারতও অফার দিয়েছে। তারাও সম্ভাব্যতা যাচাই করবে। পরে যেটা আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত, সেটা নেব। তবে আমি বেশি প্রাধান্য দেব এটা ভারত করুক।’

তিস্তা প্রকল্পে ভারতের প্রতি আগ্রহের কারণ হিসেবে সরকারপ্রধান বলেন, ‘তিস্তার পানিটা ভারত আটকে রেখেছে। ভারতের কাছে আদায় করতে হলে প্রকল্পের কাজ তাদের করা উচিত। তারা প্রকল্প করে যা প্রয়োজন, তা দেবে। এটা হচ্ছে কূটনীতি।’

ভারতের বিষয়ে জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চীন তো প্রস্তুত। কিন্তু আমি চাচ্ছি এটা ভারত করে দিক। কারণ, এ প্রকল্পের জন্য যা দরকার, ভারত দিতে থাকবে। এটা সাফ সাফ কথা। রাখঢাক নাই।’

দেশের দক্ষিণাঞ্চল সবচেয়ে অবহেলিত উল্লেখ করে সেখানে চীনকে কাজ করতে বলা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, পিরোজপুরে নবম চীন–মৈত্রী সেতু নির্মাণ করে দেবে চীন। এতে সরকারের কোনো পয়সা লাগবে না।

কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই
কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ২০১৮ সালের আন্দোলনের প্রসঙ্গ টানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় বিরক্ত হয়ে কোটা বাতিল করে দিয়েছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেটার উদ্দেশ্য ছিল কোটা বাদ দিলে কী হয়, দেখা।

এরপর বিসিএসে নারীরা পিছিয়ে পড়েছেন জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, সর্বশেষ বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে দুজন এবং পুলিশে চারজন নারী নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ নারী অধিকারের কথা বলা হয়।

দেশের সব এলাকা সমানভাবে উন্নত নয়, অনগ্রসর সম্প্রদায় আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই সব মানুষের কি কোনো অধিকার থাকবে না? কোটা বন্ধ করার পর ২৩ জেলার একটি লোকও পুলিশে চাকরি পায়নি।’

কোটা বাতিলের পর মামলা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মামলার পর আদালত যে রায় দেন, এতে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। আদালতেই সমাধান করতে হবে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সরকারপ্রধান বলেন, ‘তারা তো আইন মানবে না, আদালত মানবে না, সংবিধান কি তারা চিনবে না বা একটা কাজ করতে হলে কার্যনির্বাহীর কাজ কী, বিধিমালা বা ধারা থাকে…একটা সরকার কীভাবে চলে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা এদের নাই।’

আদালতের রায় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আদালত যখন কথা বলেছে, রায় হয়ে গেছে, সেই রায়ের বিরুদ্ধে আমার তো দাঁড়ানোর অধিকার নেই, সংবিধানও বলে না। সংসদও বলে না, কার্যপ্রণালিবিধিও বলে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসবে, ততক্ষণ আমাদের কিছু করার থাকে না। এ বাস্তবতা তাদের মানতে হবে। না মানলে কিছুই করার নেই।’

রাজাকারের নাতিরা পাবে?

সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে? তা তো আমরা দিতে পারি না।

আন্দোলন ধ্বংসাত্মক হলে ব্যবস্থা
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাজপথে আন্দোলন করছে। তবে কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারবে না। যতক্ষণ তারা শান্তিপূর্ণ করে যাচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু এর বাইরে যখন কিছু করবে, পুলিশের গায়ে হাত তোলা, গাড়ি ভাঙচুর, আক্রমণ করতে যায়, তখন তো আইন আপন গতিতে চলবে।’

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’

মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাধটা কী, এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, নিজের জীবনবাজি রেখে, সংসার সব ফেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। দিনরাত খেয়ে না খেয়ে, কাদামাটি ভেঙে, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মোকাবিলা করে যুদ্ধ করে এ দেশের বিজয় এনেছেন।

এক মুক্তিযোদ্ধার নাতি কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনি বলেন কোটা থাকবে না। তাহলে আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে বলুক যে কোটা লাগবে না।’

শিক্ষকেরা আন্দোলন করে ক্লান্ত হয়ে যাবেন
পেনশন সম্পর্কে শিক্ষকদের ধারণা বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কয়েকটি বিষয় আমি দেখে রেখেছি। সেগুলো আমরা দেব। তবে আন্দোলন তারা চালাতেই থাক, চালাতে চালাতে যখন টায়ার্ড (ক্লান্ত) হবে, তখন বলব, তার আগে বলব না। বলার দরকার কী?’

দুর্নীতির খবর সংগ্রহে বাধা
দুর্নীতির খবর সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে—এ–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাংবাদিকদের তথ্য জোগাড় করা এক জিনিস আর ফাইল চুরি আরেক জিনিস। আমি ভ্যাকসিন কিনব, আমার সেখানে নেগোসিয়েশন হচ্ছে। জরুরি পেপার। আপনাদের স্বনামধন্য পত্রিকার এক সাংবাদিক ঢুকে সেই কাগজ চুরি করতে গেল। অফিসার এসে ধরল। ফাইল চুরি করতে গেলে এটা কোনো অপরাধ নয়?’ এমন প্রশ্ন রাখেন সরকারপ্রধান।

ট্রাম্পকে গুলির ঘটনা দুঃখজনক
যুক্তরাষ্ট্র তাদের গণতন্ত্র নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলেন, ‘আমরা তো গুলি-বোমা খেয়েই অভ্যস্ত। কিন্তু আমেরিকার মতো জায়গায় হয় কী করে।’ ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে গুলির ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এর নিন্দা জানান শেখ হাসিনা।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এক পাশে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোশাররফ হোসেন, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। অন্যদিকে ছিলেন সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল হক।

Share