নয়াবার্তা প্রতিবেদক : অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রাজস্ব ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কারকে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় দু’টো চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেে এ ধরনের সংস্কার অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তা হল রাজস্ব ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার। এরপর আসবে অন্যান্য খাত ও রাজনৈতিক ফ্রন্টের সংস্কার।’
অর্থ উপদেষ্টা আজ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাল্টিপারপাস হলে ফাইন্যান্স অ্যাক্ট,২০২৪-এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করারোপজনিত পরিবর্তনের ওপর আলোচনায় বক্তব্য প্রদানকালে একথা বলেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম লুৎফুল আজিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শেখ শামীম বুলবুল। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ট্যাক্স পলিসি সদস্য এ কে এম বদিউল আলম ও ট্যাক্স অ্যাডমিন অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের সদস্য জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ।
আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যাংকিং ও রাজস্ব খাতের সংস্কারে ইচ্ছুক ও আন্তরিক। অনুগ্রহ করে আপনারা (কর কর্মকর্তাগণ) দ্রুত এটি (সংস্কারে) করতে প্রচেষ্টা চালান।’ এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে উপদেষ্টা চাহিদা মেটাতে কর কর্মকর্তাদের যতটা সম্ভব কর আদায় করতে বলেন। তিনি বলেন, ‘তবে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ দিয়ে কর আদায় করবেন না। তাদের কষ্ট না দিয়ে কর সংগ্রহের চেষ্টা করুন, যাতে আপনাদের প্রতি মানুষের আস্থা জন্ম নেয় এবং তারা স্বেচ্ছায় কর দিতে আসে।’
অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা আরো বলেন, এখন সাধারণ করদাতাদের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, হয়রানি এড়াতে তারা কর কর্মকর্তাদের কাছে আসেন না। তিনি বলেন, ‘করদাতারা যেন এ ধরনের ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে, দয়া করে সেজন্য তাদের আশ্বস্ত করুন।’ রাজস্ব সংগ্রহে শ্রেণী-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়ে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা দেশকে আত্মনির্ভর করতে চাই…যদিও এখন শতভাগ নির্ভরশীল হওয়া সম্ভব নয়, কারণ আমাদের এখনও আমাদের বিদেশ থেকে সম্পদ আনতে হবে।’
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণায়ের দ্বায়িত্ব ছাড়াও অর্থ ও বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরূদ্ধার ছাড়াও, বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে বড় সমস্যা। তিনি বলেন, সফররত মার্কিন প্রতিনিধিদল অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিবে। যদিও আগামী দুই দিন এই বিষয়ে ধারাবাহিক আলোচনার হবে। তিনি বলেন, ‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) আমাদের প্রয়োজন অনুসারে আমাদের সাহায্য করতে পারে। এখন অন্তত আমরা তাদের বলতে পারব যে কর সংস্কার শুরু করেছি, কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেছি। তাহলে তারা কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারেন।’
কিছু লোক অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ এক মাসের কর্মকা- দেখে অস্থির হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তবে আমি অন্তত বলতে পারি যে কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিলের মতো আর্থিক খাতে কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাতেও সংস্কার করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছি এবং আমরা আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে উদগ্রীব। স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে সংস্কার করতে কিছুটা সময় লাগবে।’
সরকারের প্রথম নীতি হলো সরকারি তহবিলের অপচয় না করা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমাবে না। অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয় উল্লেখ করে সালেহউদ্দিন বলেন, “আমাদের নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমেই আমাদেরকে সমস্ত চাহিদা এবং ব্যয় মেটাতে চেষ্টা করতে হবে। তবে এটাও সত্য যে শুধু আমাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়েই সব সমাধান সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত সহায়তার ক্ষেত্রে আমাদের বিদেশী তহবিল প্রয়োজন।’ সালেহউদ্দিন বলেন, ‘একটা কথা আছে যে, আপনার হাত যদি কারো পকেটে থাকে, তবে সে নড়লে আপনাকে নড়তে হবে এবং আমরা প্রতিটি দিক থেকে এটি অনুভব করছি।’ উপদেষ্টা বলেন, ‘দাতা সংস্থাগুলো সর্বদা সরকারকে পরামর্শ দিতে চায়। তবে সরকার তাদের বোঝাতে চেষ্টা করছে যে, আমরা পুরোপুরি উন্নয়ন সহযোগীদের ওপর নির্ভরশীল হতে চাই না।’ ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘দেশের চাহিদা অনুযায়ী সরকার যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণের চেষ্টা করছে। আমরা অবশ্যই সেইসব প্রকল্প গ্রহণ করব, যা আমাদের জন্য উপকারী হবে। এছাড়া, যদি বিদেশী তহবিলের জন্য কোন প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা তা অন্বেষণ করব।’
প্রত্যক্ষ কর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজস্বে প্রত্যক্ষ করের অংশ তুলনামূলকভাবে কম। অন্যদিকে ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর বেশি। করের মূলনীতি হলো সাম্যতা ও পরিশোধের স্বক্ষমতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, করের বোঝা শুধু কিছু ব্যক্তি ও ব্যবসার ওপর চাপানো উচিত নয়। সংশ্লিষ্ট সবাই এনবিআর কর্মকর্তাদের দিকে তাকিয়ে আছে উল্লেখ করে এনবিআর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কোনো করদাতা যেন রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের ভয় না পান। পাশাপাশি সবাইকে ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা উচিত। উপদেষ্টা কর কর্মকর্তাদের অধিকতর সতর্কতা ও আন্তরিকতার সাথে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে বলেন।
উপদেষ্টা জানান, আগামীকাল মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা হবে। সেখানে কর সংস্কার, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, কাস্টমস, শুল্ক ও দ্বৈত কর পরিহার অগ্রাধিকার পাবে। তিনি বলেন, সরকার যদি নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার উন্নতি না করে, তাহলে তা আরও বেশি এফডিআই, এফপিআই ও পোর্টফোলিও বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব হবে না। সালেহউদ্দিন বলেন, ‘আপনাদের উপর দায়িত্ব অনেক বেশি এবং অনুগ্রহ করে কাজগুলো দ্রুত সম্পূর্ণ করুন।’ তিনি সামনের দিনগুলোতে কর্মকর্তাদের আরো বেশি সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেন।
এনবিআর ভবন নিয়ে তার সহকর্মী উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মন্তব্যকে ‘চিত্তাকর্ষক’ হিসেবে উল্লেখ করে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, লোকজনকে আকৃষ্ট করতে ক্ষেত্রবিশেষে ভবনটির কাঠামোগত চমৎকারিত্বও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, ‘তবে অনুগ্রহ করে, আপনারাও সহজাত প্রতিভা ও প্রজ্ঞাকে সমুন্নত রেখে, নিজেদের কথা ও কাজের মাধ্যমে এনবিআর ভবনের স্থাপত্য কাঠামোগত সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলুন।’
প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদ্ধতিটি অন্যতম সেরা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থা খুবই কঠোর এবং এধরনের মান অর্জন করা খুবই কঠিন।