চাঁদপুর প্রতিনিধি : চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় মেঘনা নদীতে নোঙরে থাকা মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের সারবোঝাই আল বাখেরাহ নামক জাহাজ থেকে ৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা জাহাজে ডাকাতি করতে এলে বাধা দেওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত একজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
নিহতরা হলেন-জাহাজের মাস্টার কিবরিয়া, ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন, সুকানি আমিনুল মুন্সি, গ্রিজার সজিবুল, আজিজুল ও মাজেদুল ইসলাম। নিহত একজনের নাম জানা যায়নি। আর আহত ব্যক্তি হলেন-জুয়েল। আহত ও নিহত ব্যক্তিদের বাড়ি নড়াইল জেলায়।
মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের অপর জাহাজ মুগনি-৩ এর মাস্টার বাচ্চু মিয়া ও গ্রিজার মো. মাসুদ জানান, সার বহনকারী আল বাখেরাহ ২২ ডিসেম্বর রোববার সকাল ৮টায় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসে। এরই মধ্যে কোম্পানির মালিক শিপন বাখেরাহ জাহাজে ফোন করে কাউকে পাননি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় মুগনি জাহাজ থেকে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়। ওই সময় মুগনি জাহাজটি মাওয়া থেকে ঘটনাস্থল দিয়ে অতিক্রম করার সময় জাহাজের লোকজন বাখেরাহ জাহাজটি দেখতে পান। ওই সময় তারা জাহাজের লোকদের রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ৯৯৯-এ কল দেন।
এদিকে ৯৯৯ এ কলের সূত্র ধরে চাঁদপুর থেকে কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। নৌ পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ মোশফিকুর রহমানের উপস্থিতিতে কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ জাহাজ থেকে প্রথমে পাঁচজনের মরদেহ এবং তিনজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আনিসুর রহমান বলেন, জুয়েল নামে একজনের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গলা ও শ্বাসনালিও কাটা ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। এছাড়া উদ্ধার করা আরও দুজন সজিবুল ও মাজেদুলকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। তাদের মাথায় ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
নৌ পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ মোশফিকুর রহমান বলেন, জাহাজে ডাকাতি করতে বাধা দেওয়ায় তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাটির তদন্ত চলছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। তিনি বলেন, আহত একজন হাতের ইশারায় জানিয়েছে তারা আটজন ছিলেন। ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। ডাকাতি, কিংবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। তদন্ত করার পরে জানা যাবে। নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ে কথা বলেছি। কারণ এই রুটে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। যাতে করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়।
কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ গতকাল বেলা তিনটার পরে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে মাঝিরচর এলাকায় নোঙর করা এম ভি আল-বাখেরা নামের একটি সারবাহী জাহাজের বিভিন্ন কেবিন থেকে প্রথমে ৫ জনের লাশ উদ্ধার করে। আরও তিনজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে দুজন মারা যান। এ ছাড়া অন্যজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এদিকে ঘটনার সংবাদ পেয়ে জেলা প্রশাসক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
চাঁদপুরে নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমান ও কোস্ট গার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. ফজলুল হক জানান, দুপুর আড়াইটায় জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে কল করে জানানো হয়, জলদস্যুদের হামলায় এমভি আল বাখেরা নামক কার্গো জাহাজের স্টাফরা নিহত হয়েছেন। সংবাদ পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুটে যান তারা।
নাবিকরা জানান, নৌপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোর মধ্যে পরস্পর যোগাযোগের জন্য নিজস্ব নেটওয়ার্ক রয়েছে। আর সেই মাধ্যমে এমন সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান তারা। ঘটনার পর বিভিন্ন জাহাজের নাবিক ও স্টাফদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
তারা আরো জানান, প্রথমে ৫ জনকে মৃত অবস্থায় এবং পরে আরো ৩ জনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এদের ৩ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ২ জন মারা যান।
নিহত ও আহতদের সবার মাথায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ছোট আকারের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তাদের হত্যা করা হয়।
চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, গুরুতর আহত একজনের শ্বাসনালির অংশবিশেষ কেটে ফেলেছে হামলাকারীরা। তার অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে, তবে অবস্থা আশঙ্কাজনক।
চাঁদপুরে নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমান জানান, এরই মধ্যে দুটি মুঠোফোন জব্দ করা হয়েছে। এসব ফোনে থাকা কললিস্ট ধরে তদন্ত কাজ চলছে।
তিনি আরো জানান, এখন পর্যন্ত জাহাজ থেকে লুটপাটের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া এমভি আল বোখেরা নামের এই কার্গো জাহাজের মালিকের খোঁজ পাওয়া গেলেও ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কোস্ট গার্ড চাঁদপুর স্টেশন কমান্ডার লে. ফজলুল হক জানান, ঘটনার পর থেকে নদীতে কোস্ট গার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে।
বিকেলে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. মহসিন উদ্দিন ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে যান। জেলা প্রশাসক জানান, যারাই এই ঘটনায় জড়িত হোক না কেন। তাদের খুঁজে বের করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের ধারণা, রোববার দিবাগত রাতে দুর্বৃত্তরা নৌযানটির চালক ও অন্যান্য কর্মীদের হত্যা করে। তবে নিহতদের কারও পরিচয় পাওয়া যায়নি। হাসপাতালে নেওয়ার পর একজন কাগজে লেখেন যে, তাঁর নাম জুয়েল। গলা আংশিক কাটা থাকায় তিনি কথা বলতে পারছিলেন না।
এর আগে নৌ-পুলিশের চাঁদপুরের অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, পণ্যবাহী নৌযানটিতে থাকা ব্যক্তিদের দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা সন্দেহ করছেন, শত্রুতা থেকে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে তাঁরা আজ বেলা তিনটার দিকে নৌযানটির কাছে যান। সেখানে গিয়ে নৌযানের পাঁচটি কক্ষে পাঁচটি মরদেহ পান। বাকি তিনজনকে গুরুতর জখম অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশ বলছে, নৌযানটির মালিক মেসার্স এইচপি এন্টারপ্রাইজ।