
গাজী আবু বকর : ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন দেশের প্রধান দু’টি বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত বয়কট করায় ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা ভোটেই নির্বাচিত হয়েছিল। তাই এর নাম হয় বিনা ভোটের নির্বাচন। ঐ নির্বাচনের সাংসদদের বলা হতো ‘বিনা ভোটের এমপি’। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও নির্বাচনের আগের রাতেই বাক্সে ব্যালট ভরে রাখা হয়। তাই এর নাম হয় নিশি রাতের নির্বাচন। ঐ সংসদের সাংসদদের বলা হতো ‘নৈশ ভোটের এমপি’। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো বয়কট করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্ধিতা করলে এটার নাম হয় ডামি বা সাজানো নির্বাচন। আর ঐ নির্বাচনের সাংসদদের বলা হতো ‘মনোনিত এমপি’। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এই তিনটি নির্বাচনে একতরফাভাবে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। অভিযোগ আছে, এ সব নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি হয়েছিলো। ফলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আছে তুমুল সমালোচনা ও বিতর্ক। দীর্ঘ বছর পর এবার পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের বিতর্কিত তিনটি সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছে। ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে এ সব সাবেক ডিসিদের বাধ্যতামূলক অবসরের তালিকা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত জনপ্রশাসন-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের সভার সুপারিশের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত আসছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিতর্কিত ও একপেশে এই তিনটি সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় নিয়জিত সাবেক জেলা প্রশাসকদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, তাদের কাউকে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। যাদের চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হয়নি, তাদেরকে জনপ্রশাসনে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখা হয়। তবে বর্তমান সরকারের কিছু আমলা চাইছেন, ওএসডি থাকা সাবেক ডিসিদেরও চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হওয়াসাপেক্ষে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে।
আগামী মে মাসেই ২০ ব্যাচের যারা ডিসি ছিলেন সে সব কর্মকর্তাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হবে। এমনটা হলে তাদের বাধ্যতামূলক অবসরের তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। একই সিদ্ধান্ত ২১ ব্যাচের ডিসিদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। এখানেই শেষ নয়, ওই সময় নির্বাচনকালে ঐসব ডিসি আর্থিক সুবিধা নিয়ে অবৈধ সম্পদ করেছেন কি না, সে বিষয়েও তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদককে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তাদের নামের তালিকা দুদকে পাঠানো হয়েছে। এরপর থেকেই দুদক তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে বলে সরকারের একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরকার-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর শাসনামলে গত ১৫ বছর ভোটারবিহীন ও একতরফা তিনটি বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওইসব নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও বিভাগীয় পর্যায়ে থাকা কমিশনাররা। তাদের নেতৃত্বেই পুলিশের সহায়তায় এসব ভোটারবিহীন নির্বাচন করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করা হয়। বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের অপরাগতা প্রকাশ না করে বরং তারা বিশাল অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তারা জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারে মতো দায়িত্ব পালন শেষে পুরস্কার হিসেবে ওই সরকারের সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। প্রশাসনে অত্যন্ত প্রভাবশালী হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত হয়েছেন। তারা ছিলেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী, প্রভাবশালী ও দলবাজ কর্মকর্তা। তাদের কারণে অন্য কর্মকর্তারাও হয়েছেন পদোন্নতি বঞ্চিত। দলনিরপেক্ষ, যোগ্য ও মেধাক্রমের অগ্রভাগে থাকলেও অনেকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে বছরের পর বছর বঞ্চিত করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আট মাসের বেশি সময় পার করছে। পতিত সরকারের আমলে বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের বিষয়ে সরকার গঠিত জনপ্রশাসন-সংক্রান্ত কমিটি পর্যালোচনা করেছে। কমিটি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কিছু সুপারিশ করে। এরপরও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করে। প্রথম দফায় কোনো কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে না পাঠিয়ে ৪৩ জনকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়। পরবর্তীতে কঠোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিতর্কিত তিনটি সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বরত ছিলেন-এমন ২২ সাবেক জেলা প্রশাসককে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদমর্যাদায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও অধিদপ্তরে দায়িত্বরত ছিলেন। এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয় বিসিএস ১১ ব্যাচের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব কামরুল হাসান এনডিসি, সাবেক এলজিআরডি সচিব (ওএসডি) আবু হেনা মুর্শেদ জামান, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা। এদের মধ্যে দুজন তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যে একটিতে জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় তাদের কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। অন্যদের জনপ্রশাসনে ওএসডি রাখা হয়েছে। নীতিনির্ধারকদের মতে, এমন কঠোর পদক্ষেপ দেখে প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারাও ‘কঠোর বার্তা’ বলে মনে করবেন। ভবিষ্যতে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার দায়িত্ব পালনে দলীয় প্রভাব এড়াতে আরও সতর্ক হবেন। যেকোনো সরকারের অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করারও সাহস পাবেন না। কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়, এমন বার্তা সব কর্মকর্তাই অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখবেন বলে তারা মনে করছেন। অভিযোগ রয়েছে- পতিত শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারকে দীর্ঘায়িত করতে বিতর্কিত ও একপেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন বর্তমানে বাধ্যতামূলক অবসর বা ওএসডিতে থাকা এসব কর্মকর্তা। তারা মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থেকে পুলিশ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে দিনের ভোট রাতে আয়োজনে মুখ্য কারিগর হিসেবে কাজ করেছিলেন। তারা যদি ওই সময় ভোটারবিহীন নির্বাচনে অপারগতা প্রকাশ করতেন, তাহলে পতিত সরকার দেশে বিতর্কিত নির্বাচন করতে পারত না। ছাত্র-জনতার প্রাণহানি হতো না। এছাড়া ওইসব নির্বাচনে ব্যাপক আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
সূত্র বলছে, সাবেক ডিসিদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের সংশ্লিষ্টতা খুঁজতে দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থা নিবিড়ভাবে তদন্ত শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টতা পাওয়াসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। এমন খবরে পতিত সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পাশাপাশি অতীতে সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, অথচ এখনও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পেশাদারত্বের সাথে কাজ করছেন, তাদের আবার ওএসডি করা হবে কি না- এমন শঙ্কাও তাদের মধ্যেও কাজ করছে। তবে যারা দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসনে কাজ করেছেন, তাদের বিষয়ে বর্তমান সরকার ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করবে।