
গাজী আবু বকর : দেশের মানুষ ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। আগামী ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ’ নির্বাচনের আলোচনায় সমসাময়িক কিছু ঘটনা রাজনীতিতে তৈরি করেছে উত্তেজনা। এসব ঘটনায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে নির্বাচন কবে হবে সেই প্রশ্ন। জাতির নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের মুলা। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন চলতে শুরু করেছে। স্বল্প সংস্কার হলে ডিসেম্বর, বৃহৎ সংস্কার হলে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে হবে নির্বাচন। এখন মে মাস চলছে। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে সামনে মাত্র ৭ মাস সময়। অথচ ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে সংস্কারের অজুহাতে নির্বাচন নিয়ে চলছে তালবাহানা। নির্বাচনের দিনক্ষণের চূড়ান্ত ঘোষণা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচনের মুলা কি দেশবাসীর সামনে ঝুলেই থাকবে?
দেশে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় নির্বাচনের নামে হয়েছে নাটক। ভোটাররা দিতে পারেনিভোট। ১৮ বছর বয়সে ভোটারের তালিকায় নাম উঠলেও দেশে যাদের বয়স ৩০/৩৫ বছর তারা এখনো ভোট দিতে পারেনি। জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে চলে গেছেন। অতঃপর গঠন করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জনগণ ভোটের অধিকার চাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করছে নির্বাচন। কিন্তু সেই নির্বাচনের রোডম্যাপ এখনো অধরা।
এতো কিছুর পরেও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, কোনো ঘটনাই জাতীয় নির্বাচনের মতো জনদাবিকে আড়াল করতে পারবে না। একই রকম ধারণা জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরও। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করে নির্বাচনের পথনকশা চেয়ে আসছে বিএনপি। আর কিছু মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে সম্ভব হলে ডিসেম্বরেই, তা না হলে আগামী বছরের শুরুর দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান চায় জামায়াত। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে সংঘটিত কিছু ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে। যার রেশ এখনো রয়ে গেছে। এর মধ্যে গত এপ্রিলের শেষ দিকে রাজনীতিতে প্রধান আলোচ্য বিষয়ে হয়ে ওঠে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের রাখাইনে খাদ্যসহায়তা পাঠানোর জন্য ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনা। সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা এ-সংক্রান্ত বক্তব্যের পর রাজনৈতিক দলগুলোতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাষ্ট্রব্যবস্থার নানামুখী সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চলছে আলোচনা।
দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা। বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। অনিশ্চয়তার কারণে নতুন বিনিয়োগ আসছে না; দেশি বিনিয়োগও বাড়ছে না। এপ্রিলের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ এ বিদেশিরা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা বিনিয়োগের আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা চায়। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল অনিশ্চিত; নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে বিনিয়োগ করবে বলে বার্তা দেয়। অথচ নির্বাচন কখন হবে তা কেউ জানেন না। উল্টো সংস্কারের নামে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা করছেন।
এমন সময়ে ‘করিডর’ নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপের সৃষ্টি হয়। এই উত্তাপের মধ্যেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি হঠাৎ তীব্রভাবে সামনে আসে। গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখভাবে থাকা তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অন্যতম নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এতে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামসহ কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক বিভিন্ন দলমতের অনুসারী নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা সমর্থন জোগান। এ দাবিতে টানা তিন দিন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি বাসভবন ‘যমুনা’ ঘিরে অবস্থান, অবরোধ ও গণজমায়েতের কর্মসূচির মধ্যে সরকার আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করার ঘোষণা দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নির্বিচার গুলি করে মানুষ হত্যার দায়ে শেখ হাসিনা, তাঁর সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের পাশাপাশি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত সপ্তাহের তিন দিনের এই আন্দোলন রাজনৈতিক মহলে নতুন ভাবনার উদ্রেক করেছে। আবার গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃস্থানীয় তরুণদের মধ্যে বিভক্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনগুলো এক জায়গায় এসেছে। এটাকে রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিরা আগামী নির্বাচন ও ভবিষ্যতের রাজনীতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা মনে করছেন। তবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়গুলো সামনে আসায় নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছে, এমনটা মনে করেন না এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব৷ তিনি মতে, বিএনপি উল্টো অতি দ্রুত নির্বাচনকে বেশি ফোকাস করে বর্তমান জাতীয় স্বার্থ বা আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে শক্ত ভূমিকা রাখছে না৷ এনসিপির দিক থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো দাবিগুলো নির্বাচন পেছানোর জন্য তোলা হয়নি৷ এগুলো তোলা হয়েছে জাতীয় স্বার্থে৷এনসিপির ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বলছে, গাজীপুরে হাসনাত আবদুল্লাহর ওপর হামলার কয়েক দিনের মাথায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে হাসনাত আন্দোলনের ডাক দেন। এতে এনসিপির নেতৃত্বে শুরুতে দ্বিধা ছিল। পরে সবাই একসঙ্গে রাস্তায় নেমে ভূমিকা রাখলেও কৃতিত্ব যায় হাসনাতের অনুকূলে। এতে ভেতরে-ভেতরে এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বে অস্বস্তি ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। যদিও এনসিপি শুরু থেকেই ফ্যাসিবাদী দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি করে আসছিল।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, ‘এর জন্য তো (আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে) অবরোধ করার দরকার নেই। বিএনপি লিখিতভাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। আমরা মনে করি, বিচারের মাধ্যমে এর সমাধান হবে।’ এই মুহূর্তে বিএনপির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নির্বাচন। এই লক্ষ্যে দলটি একদিকে নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে; অন্যদিকে তরুণদের লক্ষ্য করে বিভাগীয় পর্যায়ে ‘তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার’ সমাবেশ শুরু করেছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা এখন নির্বাচন ছাড়া নতুন-পুরোনো কোনো ইস্যুকেই ধর্তব্যে আনতে চাইছেন না। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অভিমত, কিছু মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবি থাকবেই। স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির জন্য মানুষের ভোটাধিকার তো আটকে থাকবে না। তাঁর মতে, বিগত ১৫ বছর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মালিক ছিলেন। এখন বাংলাদেশের মানুষ নতুন কোনো মালিক দেখতে চায় না। অনেকের অনেক দাবি আছে, তাদের দাবিগুলো নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে। নির্বাচনই এর সমাধান।
এ দিকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর উদ্যাপনের মধ্যেই সামনে আসে শাহবাগের গণজমায়েতের কর্মসূচিতে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের কর্মী-সমর্থকদের বিতর্কিত স্লোগান এবং জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়ার ঘটনা। এর রেশ ধরে সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম একাত্তরের গণহত্যার সহযোগীদের ক্ষমতা চাইতে হবে বলে নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট দেন। যিনি অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুসের ভাষ্যানুযায়ী ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মাস্টার মাইন্ড ও অন্যতম নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের বিতর্কিত ভূমিকার ইঙ্গিত করে মাহফুজ আলম ওই পোস্ট দেন বলে মনে করা হয়। কারণ, তাঁর ওই পোস্টের পর এনসিপি এবং জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ পাল্টাপাল্টি প্রচারণা শুরু করে, যা এখনো চলছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জাতীয় সংগীতের অবমাননার প্রতিবাদে ‘সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত’ নামে একটি কর্মসূচি হয়, যেখানে এনসিপির ছাত্রসংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন অংশ নেয়। এ বিষয়ে আরও কর্মসূচি হওয়ার কথা রয়েছে। এ ধরনের নতুন নতুন ঘটনা ও বিতর্ক জাতীয় নির্বাচনকে অনিশ্চয়তায় ফেলার চেষ্টা কি না, রাজনৈতিক মহলে সন্দেহের উদ্রেক করছে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের মতে, ‘একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। আমরা মনে করি, কিছু বিষয়ে সংস্কার নির্বাচনের আগে জরুরি। রাজনৈতিক অংশীজনদের মৌলিক যে দাবিগুলো আছে, বর্তমান সরকার সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে সংস্কার করবেন এবং আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। অন্যথায় দেশে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।’