
বিশেষ প্রতিবেদক : ডেইলি নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর মনে করেন, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ‘কিছু লীগপন্থী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা’ দায়ের হয়েছে। তাঁর মতে এসব সাংবাদিক আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন জানিয়ে ‘রাজনৈতিক অপরাধ’ করেছেন। তবে ‘পত্রিকার সম্পাদকদের এখন আর আওয়ামী জমানার মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সাংবাদিকতা সম্পর্কে নসিহতমূলক বার্তা গ্রহণ করতে হয় না।’
ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম মনে করেন, ‘গণহারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের আক্রমণ (মামলা) স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী এবং এটি ভয়ের ব্যাপার।’ উপদেষ্টা হিসেবে আইন মন্ত্রণালয় অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল যথাযথভাবে সামাল দিতে না পারার দায় এখানে আছে। এর ফলাফল হচ্ছে ‘সাংবাদিকরা হত্যা মামলার আসামি’ বলে তার অভিমত।
দুই সম্পাদকই একটি ক্ষেত্রে একমত, তা হলো- যথাযথ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগের বিচার হতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে খুনের মামলা দায়েরের ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো সরকারকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন জানানো ‘রাজনৈতিক অপরাধ’ হলেও তা কখনো খুনের মামলার মতো ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।’
তবে নিজের সাংবাদিকতা–জীবনে মামলা, হামলা ও জেল খাটার কথা তুলে ধরে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘কোনো সরকারের আমলেই তিনি ভালো ছিলেন না। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মন খুলে লিখতে বলেছেন। এটা আশার কথা।’
সাংবাদিকরা কী লিখতে পারছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপ থেকে বের হতে পারছেন না। এখান থেকে বের হতে না পারলে যাত্রাটা কঠিন হবে।’ কিছুসংখ্যক সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকারও সমালোচনা করেন মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ভারতে যদি ‘গদি সাংবাদিক’ হয়, বাংলাদেশে হবে ‘তেলবাজ সাংবাদিক’। অনেক সাংবাদিক বেতন পান না এটা যেমন ঠিক, আবার অনেকের বেতন প্রয়োজন হয় না, এটাও স্বীকার করতে হবে। এ দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলতে হবে। আত্মসমালোচনাও করা উচিত।
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আজ নূরুল কবীর বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক জমানার তুলনায় সাধারণভাবে অবশ্যই সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার সরকারকে বরং সমালোচনা করার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তার (মহাম্মদ ইউনূস) সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে, এমনকি তার নিজের বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কেও আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রেখেছি। দৈনিকটি নূরুল কবীরের ওই সাক্ষাৎকার আজ ১৮ই মে রোববার প্রকাশ করেছে।
সেখানে নূরুল কবীর বলেন, ‘পত্রিকার সম্পাদকদের এখন আর আওয়ামী জমানার মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সাংবাদিকতা সম্পর্কে নসিহতমূলক বার্তা গ্রহণ করতে হয় না। তবে … সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ও গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী কোনো কোনো নেতা ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার প্রতি খানিকটা বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা অনাকাঙ্ক্ষিত বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এটা নিশ্চয় বিপজ্জনক লক্ষণ। এ লক্ষণের বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার কিছু লীগপন্থী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন জানানো একটি নৈতিকতাবিবর্জিত রাজনৈতিক অপরাধ, কিন্তু তা সাধারণভাবে কখনো একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক দুর্নীতিচর্চার মামলাও রুজু করা হয়েছে। যথাযথ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে, স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ায় সেসব অভিযোগের বিচার হতেই পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে খুনের মামলা দায়েরের ব্যাপারটি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।’
গত ১৬ই মে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক কলামে মাহফুজ আনাম লেখেন, ‘কারো যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বরং উপদেষ্টাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনের দিকে তাকালেই বর্তমান বিশৃঙ্খলার একটি চিত্র স্পষ্ট হয়। … আমরা আইন এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ন্যস্ত করেছি একজনের কাঁধে। ফলাফল, আমাদের দেশে সাংবাদিকরা হত্যা মামলার আসামি এবং আইনি ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে নাগরিকদের হয়রানি, ভয় দেখানো ও অর্থ আদায়ের অস্ত্রে।’
গত ৪ঠা মে ঢাকায় সম্পাদক পরিষদের আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মাহফুজ আনাম বলেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনামল এত জনধিক্কৃত হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং আরও অনেক আইনের শিকার হয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা–সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ২০০ বা কিছু বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। ২৬৬ জন সাংবাদিক আজকে খুনের মামলা, বা সহিংসতা–সংক্রান্ত অপরাধের মামলার আসামি। এটা আমাদের জন্য অসম্মানের।’
সরকারের উদ্দেশে ওই অনুষ্ঠানে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘এটার অর্থ এই নয় যে, কেউ দোষ করেননি। দোষ করে থাকলে সঠিকভাবে মামলা করে শাস্তি দেন এবং আমরা কোনোভাবেই তার পাশে দাঁড়াব না, যদি তিনি সত্যিকার অর্থে সমাজের বিরুদ্ধে বা জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের বিরুদ্ধে তার অবস্থান সে রকম থাকে। আজকে ছয় থেকে সাত মাস হয়েছে, তারা এসব মামলায় পড়েছেন। একটি কদমও এগোয়নি তদন্তের ব্যাপারে।’
যাদের নামে মামলা হয়েছে, সেসব সাংবাদিক একটা ভয়ের মধ্যে থাকেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা ‘মব আক্রমণের’ (দলবদ্ধভাবে আক্রমণ) ভয়ে থাকেন। এ রকম দু-একটা ঘটনা ঘটেছে।
১৩ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার আছেন উল্লেখ করে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘তারা যদি অপরাধ করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তাদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু আজকে সাত মাস, আট মাস ধরে কারাগারে, তারা জামিন পাচ্ছেন না। তাদের আইনি কোনো প্রক্রিয়া চলছে না। বিচার হচ্ছে না। তাহলে এটা কি চলতে থাকবে?’
ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, ‘যে সাংবাদিক দোষী, যে সাংবাদিকের শাস্তি হওয়া উচিত, আমরা সরকারের পক্ষে থাকব। কিন্তু খামোখা একেবারে গণ আকারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ আক্রমণ আমি মনে করি স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য বিরাট একটা পরিপন্থী ব্যাপার ও এটা ভয়ের ব্যাপার।’