
নিজস্ব প্রতিবেদক : স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের সময় আরও তিন থেকে পাঁচ বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে দেশের ১৬টি শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন। এত দিন বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন আলাদাভাবে বললেও এবার তারা একযোগে এলডিসি পেছানোর দাবি জানাল।
গতকাল রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘এলডিসি থেকে উত্তরণে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান ব্যবসায়ী নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য দেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি। তবে সফল ও টেকসই উত্তরণের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের বাড়তি সময় প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে এলডিসি উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের নির্ধারিত তিনটি শর্ত পরপর দুবার পূরণ করেছে। শর্তগুলো হচ্ছে মাথাপিছু আয়ের মানদণ্ড, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক। গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ—এমন সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের। সময় আছে মাত্র ১৫ মাস।
এলডিসি উত্তরণ পেছানোর দাবি জানানো সংগঠনগুলো হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি), বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ), ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএপিআই), মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই), বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি), চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই), তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিএসআইএ), ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই), নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ এবং লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি)।
আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রেস ব্রিফিংয়ে মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন আইসিসিবির সহসভাপতি এ কে আজাদ ও নাসের এজাজ বিজয়, এমসিসিআইয়ের সভাপতি কামরান টি রহমান, বিসিআইয়ের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিএবির চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার, ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাঈদ আহমেদ, বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির, ঢাকা চেম্বারের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি রাজীব এইচ চৌধুরী, এলএফএমইএবির জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বিএসআইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম ই চৌধুরী শামীম, ফরেন চেম্বারের বোর্ড সদস্য রুবাবা দৌলা, বিএপিএলসি সদস্য মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী প্রমুখ।
পাঁচ কারণ দেখিয়েছেন ব্যবসায়ীরা
সংবাদ সম্মেলনে আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান জানান, অন্তত পাঁচটি কারণে এলডিসি উত্তরণের জন্য আরও তিন থেকে পাঁচ বছরের বাড়তি সময় প্রয়োজন। এর অন্যতম কারণ হলো, এলডিসি পেছানো গেলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আঘাত মোকাবিলায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, আসিয়ান জোট ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি (এফটিএ) নিশ্চিত করা যাবে।
অন্য কারণগুলো হলো ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি), চামড়া, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হালকা প্রকৌশল খাতে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা; চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, যেমন অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো; গুণগত মানসম্পন্ন প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করা এবং সুশাসন জোরদার ও জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরি করা, যেন অস্থির বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও প্রতিযোগিতামূলক থাকা যায়।
মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা মনে করি তিন থেকে পাঁচ বছর অতিরিক্ত সময় পেলে অর্থাৎ ২০৩২ সালে এলডিসি উত্তরণ হলে বেসরকারি খাত ও সরকার উভয়েই ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবে। এ জন্য আজ আমরা সব খাতের প্রতিনিধি মিলে এই প্রস্তাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করছি।’
অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আমরা ব্যবসা ও পণ্য বৈচিত্র্য বাড়াতে চাই। দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাক সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত একটি খাত, এটি ঠিক। আবার উপযুক্ত সময়ে এলডিসি উত্তরণ না হলে আমরাই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হব। এ জন্য প্রস্তুতি নিতে সময়টা লাগছে।’
আইসিসিবির সহসভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের প্রক্রিয়ায় ঢুকে গেছে। ফলে এলডিসি উত্তরণ হতেই হবে। তবে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে উত্তরণ নিয়ে দর–কষাকষি করা ও সময় বাড়ানো প্রয়োজন। এলডিসি উত্তরণ পেছানোর জন্য আমাদের কাছে যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সুযোগও আছে। ফলে বাংলাদেশ সময় বাড়ানোর আবেদন করতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মতো একই ধরনের কারণে অন্য কয়েকটি দেশ বাড়তি সময় পেয়েছে। এটিও বিবেচনায় নিতে পারি।’
রপ্তানিসহ যেসব ঝুঁকির কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মাহবুবুর রহমান বলেন, সফলভাবে এলডিসি উত্তরণ নিশ্চিত করতে সঠিক প্রস্তুতি জরুরি। কারণ, উত্তরণের সঙ্গে নতুন দায়িত্ব ও ঝুঁকিও তৈরি হবে। এলডিসি উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্যসহ বড় বড় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে। এতে রপ্তানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ কমে যেতে পারে।
এ ছাড়া রপ্তানিতে ভর্তুকি ও মেধাস্বত্বের চুক্তি বাস্তবায়নে শিথিলতার মতো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিশেষ সুবিধা আর থাকবে না। সহজ শর্তের ঋণ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাজারভিত্তিক ঋণ নিতে হবে এবং ঋণ শোধের চাপও বেড়ে যাবে।
প্রস্তুতি ছাড়া এলডিসি উত্তরণ হলে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা বোঝাতে ওষুধ ও তৈরি পোশাক খাতের উদাহরণ দেওয়া হয় সংবাদ সম্মলনে। মাহবুবুর রহমান জানান, বাংলাদেশ ২০৩২ সাল পর্যন্ত ট্রিপস ওয়েভারের (পেটেন্ট ছাড়) সুবিধা পাচ্ছে। ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি উত্তরণ হলে এই ছাড় আর থাকবে না। তখন ওষুধশিল্পকে পূর্ণ পেটেন্ট আইনের অধীন থাকতে হবে। এতে যেকোনো ওষুধ বিশেষ করে ক্যানসার ও ভাইরাসজনিত রোগের ওষুধের দাম অত্যধিক বেড়ে যাবে। যেমন বর্তমানে একজন ক্যানসারের রোগীর জন্য প্রতি মাসে ৩০-৪০ মার্কিন ডলারের ইমাটিনিব ওষুধ লাগে। এটির দাম বেড়ে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার ডলার হতে পারে। অন্যদিকে এলডিসি উত্তরণের পর তৈরি পোশাক খাতকেও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা বন্ধ হবে, উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, নিয়মকানুন আরও কঠোর হবে।
অর্থনৈতিক বাস্তবতাও নেই
সংবাদ ব্রিফিংয়ে আইসিসিবির সভাপতি বলেন, এলডিসি উত্তরণের জন্য অনুকূল অর্থনৈতিক বাস্তবতা নেই। এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশের বড় বাধা হচ্ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস–সংকট। নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ না থাকলে তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও ওষুধশিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে না। এতে উত্তরণের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক সুদের হার ও অভ্যন্তরীণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এতে ঋণপ্রবাহ কমছে। আবার বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পাল্টা শুল্ক রপ্তানি খাতে চাপ বাড়িয়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেও বাংলাদেশ অনেক বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ অবস্থায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস–সংকট সমাধান; অবকাঠামো, সরবরাহ শৃঙ্খল ও অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানো; ব্যবসায়ের খরচ কমানো; রপ্তানি বৈচিত্র্য আনা; স্মার্ট কূটনীতির মাধ্যমে বাজার রক্ষা; আর্থিক খাতের সংস্কার; বিনিময় হারের স্থিতিশীলতাসহ প্রয়োজনীয় কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। এ জন্য অন্তত পাঁচ বছর সময় বাড়ানো প্রয়োজন।
মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের আলোচনার বিষয় এটা নয় যে আমাদের উত্তরণ হবে কি না; বরং এটা যে কীভাবে আমাদের উত্তরণ হবে। ২০৩২ সাল নাগাদ এলডিসি উত্তরণ পেছানো গেলে বেসরকারি খাত ও সরকার উভয়েই ভালো প্রস্তুতি নিতে পারবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনকে চ্যালেঞ্জ নয়, বরং বড় সুযোগে পরিণত করতে পারবে।’
উত্তরণ পেছানোর উদাহরণ আছে
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এর আগে অনেক দেশ জাতিসংঘের শর্ত পূরণ করলেও অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণে এলডিসি থেকে উত্তরণ পিছিয়ে দিয়েছে। মালদ্বীপ, ভানুয়াতু, সামোয়া, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, নেপাল, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, মিয়ানমার, তিমুর প্রভৃতি দেশের সময় বাড়ানো হয়।
মাহবুবুর রহমান বলেন, বিশেষ করে যেসব দেশ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বা বহিস্থ ধাক্কার মুখে পড়ে, অথবা উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের ঘাটতি থাকে কিংবা অবকাঠামোগত প্রস্তুতি যথেষ্ট থাকে না, তাদের জন্য টেকসই উত্তরণের সময় বাড়ানো অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সরকারের সঙ্গে বসা হবে
এলডিসি উত্তরণ সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছেন কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে সরকারের কাছে আমরা যৌথ বিবৃতি দিলাম। তবে সরকারের সঙ্গে আমরা অবশ্যই বসব। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সবকিছু সরকারের মাধ্যমেই করা হবে। কিন্তু প্রিম্যাচিওর গ্র্যাজুয়েশন হলে আমরা অনেক সমস্যায় পড়ে যেতে পারি।’
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবসায়ীদের এ দাবি উপেক্ষা করে উত্তরণের পথে এগিয়ে গেলে সেটিকে আপনারা কীভাবে দেখবেন। জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এসেছে। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার আগের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি যে এভাবে না গিয়ে কিছুটা সময় দিলে আমরা আরও শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড়াতে পারতাম।’
ইতিমধ্যে সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথা হয়েছে জানিয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে কথা বলা কারও একার বিষয় না। এ জন্য আমরা বাণিজ্য সংগঠনগুলো সবাই মিলে সরকারকে বলেছি। সরকার বিষয়টি উপেক্ষা করছে না। সরকার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে আশা করছি।’